নেলি চিৎকার করে উঠল, তু হামারে ব্যাশ্যা না বানাবি বাবু।
আবার সহসা আকাশ ভেঙে পড়ল ছাদে। দুঃখবাবু নেলির কথা শুনতে পেলেন না। নেলি এখন নিজেই পাগলের মতো দুঃখবাবুকে পেঁচিয়ে ধরেছে। দুঃখবাবুর শরীরের সঙ্গে নেলি এখন মিশে যেতে চাইছে। আর দুঃখবাবু যেন বুঝলেন, ওটা সত্যি নেলির শরীর মাত্র।
ভোরবেলায় সকলে মিলে একটা বাজপড়া মরা মানুষকে চটানে এনে তুলেছিল। সকলে দেখল সেটা গোমানির। জিয়াগঞ্জে ভোজ খেতে খেতে মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। রাতেই সে মেয়েটার জন্য ছুটল। রাতের জল—ঝড় ওকে আটকাতে পারেনি। হঠাৎ বাজ পড়ে চটানে উঠে আসতে সে মরল।
গোমানিকে ঘাটে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাটোয়ারিবাবু সামনে দাঁড়িয়ে সব কাজগুলো করলেন। কৈলাস কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। ওকে রাত করে ছেড়ে না দিলেই হত। অনেক দিন পর চটানের সকলে বড় রকমের একটা শোক পেল। ওরা সকলেই প্রায় কেঁদেছে। জোরে জোরে। শুধু নেলি অপলক চেয়ে ছিল। ব্যাপারটাকে সে যেন বুঝতে উঠতে পারেনি অথবা বাপ মরেছে এ—কথা সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কেমন হতভম্ব, কেমন পাথর বনে গেছে নেলি। তবু সন্ধ্যার সময় শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে ঘরে তুলতে ভুলল না, কবুতরের টঙ বন্ধ করতে ভুলল না। যন্ত্রের মতো কাজগুলো করল। ঘরের লম্ফটা জ্বেলে বসতেই কৈলাসের বৌ এল, হরীতকী এল, মংলি এল। ওরা সকলে ওকে ঘিরে বসল। নানারকমের কথা বলে ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। নেলি কথা বলল না, শুধু চুপচাপ শুনল। দরজার দিকে চেয়ে ভাবল—বাপ আর এখানটায় বসবে না। বাপ আর গালমন্দ দেবে না। বাপের আশায় সে আর শিবমন্দিরের পথে বসে থাকবে না। এইসব ভেবে নেলির কান্না আসছে। নেলি কাঁদতে থাকল।
যত বাপের কথা মনে হচ্ছে তত নিজেকে শাপ—শাপান্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে নেলির। মনে হল রাতের আঁধারে দুঃখবাবুর ঘরে না গেলেই হত। এমন করে শরীরের গরমে না ভুগলেই হত। নিজের শরীরটাকে বসে বসে এখন কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। বারবারই মনে হচ্ছে ডাকঠাকুর নেলির পাপের বোঝা বাপের মাথায় ফেলেছে। বাজ হয়ে ডাকঠাকুর বাপের মাথায় পড়ল। মেলিকে সমঝে দিল—ওটা ভালো কাজ লয়। অমন কাজ করতে নেই। করলে ফের ভুগতে হবে।
হরীতকী বলল, হামার ঘরে আয় তু। দুটো খাবি। সারাদিন কিছু খাসনি। এখন তুকে দুটো খানা মুখে দিতে হবে।
পিসি হামার ভালো লাগছে না।
এটা কী ভালো লাগার কথা! বকা—ঝকা করত, লেকিন এ চটানের আদমি ত ও। তার লাগি তু না খাবি, শরীর মন্দ করবি ও আচ্ছা বাত লয়। একা একা থাকবি ত মন আওর জায়দা খারাপ হোবে। হরীতকী নেলির হাত ধরে টানতে থাকল।
নেলি হরীতকীর ঘরে চলে গেল।
কৈলাস দাওয়ায় বসে তামাক টানতে টানতে গোমানির কথা ভাবল। কৈলাসের কাছে দুনিয়াটা খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। গোমানি এ—চটানে আর চিল্লাবে না ভাবতে বড় কষ্ট হয়। তবু উঠতে হবে ভাবল কৈলাস। ফরাসডাঙায় যেতে হবে। কঙ্কালটার নসিবে শেয়াল—খটাশের অত্যাচার কতটা বেড়েছে তা দেখতে হবে। সে উঠে পড়ল।
শনিয়া চুপচাপ মাচানে বসে আছে। গেরু বাঁশে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়েছে। এ—শাদির সঙ্গে গোমানির মাথায় বাজ পড়ার কোনো অদৃশ্য হাত আছে যেন। গেরু, শনিয়া মনে মনে এমনই কিছু আন্দাজ করছে।
কৈলাস ডাকল, হে রে গেরু একবার যে ফরাসডাঙায় যানে লাগে!
গেরু বুঝল বাপ তাকেও ফরাসডাঙায় যেতে বলছে। সে উঠল। শনিয়ার দিকে চেয়ে বলল, তু অমন না ভাবিস। সে বলল, হাম ফরাসডাঙায় যাচ্ছে।
কৈলাস এবং গেরু সেইমতো হাতে বল্লম নিয়ে কাঁধে মদের ভাঁড় নিয়ে বের হয়ে পড়ল। কৈলাস সঙ্গে একটা কোদাল নিল এবং একটা গামছা নিল। কঙ্কালটা তুলে আজই লিয়ে আসতে হবে। সাবান—সোডাতে সেদ্ধ করতে হবে। দুধের মতো রঙ ধরাতে হবে কঙ্কালের গায়ে। দেরি হলে কঙ্কালের গায়ে দাগ পড়বে।
নদীর পারে নেমে শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফের কৈলাস, গোমানিকে মনে করতে পারল। ওর উপকারের কথা মনে হল। বহু দেশ—বিদেশ ঘুরে প্রথম যেদিন সে এ—চটানে এসেছিল থাকবার জন্য বাঁচবার জন্য তখন গোমানিই তাকে থাকবার এবং বাঁচবার সব রকমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। গোমানি তখন বড় রকমের জোয়ান দু—দশ চটানের। গলায় মোটা কালো কারে সাদা তাবিজ। পালোয়ানের মতো দেখতে। অথচ সে চেহারা বড় বেশি জলদি নেতিয়ে পড়ল চটানে। গোমানির সেই পয়মাল চেহারা বড় জলদি ভেঙে গেল।
কৈলাস হাঁটতে থাকল।
গেরু হারিকেন হাতে আগে আগে ছুটছে, ওকে ছুটতে দেখে কৈলাস ভাবল—গেরু গোমানির মতো পয়মাল হয়ে উঠছে দিন দিন। সে ভেবে খুশি হল যে পুষে বড় করা বাচ্চাটাকে পয়মাল করে তুলতে পেরেছে। শাদি—সমন্দ হয়ে গেল; শনিয়া বিবি চটানে এল। বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করার একটা মানুষ থাকল। অথচ গেরুকে বড় করার জন্য কৈলাসের একদিন কিনা মেহনত। একদা এই গেরুর জন্য ওকে সব কিছু করতে হয়েছে। গেরুর মা নিজে চলে গিয়ে গেরুর হিসাব ওকে দিয়ে গেল। গেরুর মা বেইমানি করেছে, কিন্তু সে করেনি।
চলতে চলতে মনে হল গেরুর মাকে সে বড় বেশি পিয়ার করত। বড় বেশি সুখ দেওয়ার চেষ্টা করত। অথচ বৌটা বুঝল না, ভালোবাসার দাম দিল না। জোয়ান মরদের লোভে পড়ে চটান ছেড়ে পালাল। গাছগাছালিও চুরি গেল। ওর অভাব বাড়ল। হেকিমি—দানরির ব্যবসা গেল, সঙ্গে সঙ্গে উপোস আরম্ভ হল চটানে। গেরুটাও টাঁও টাঁও করে কাঁদে। ঘরে ঘরে উঁকি মারে—ওর মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার দিতে পারছে না কৈলাস।