এমন সময় হরীতকীর ঘরের বাচ্চাটা কেঁদে উঠল। দূরে রাত পেঁচা ডাকল। ঝাউগাছটার মরা ডালে শকুনেরা পাখা ঝাপটাল। শ্মশানে মড়া নেই। সুতরাং আগুন জ্বলছে না। পিসি ঘুমের ভিতরই বাচ্চাটাকে ষাট সোহাগ করছে।
নেলি ফের ডাকল তার ঈশ্বরকে, ডাকঠাকুর, তু হামারে ভরসা দে লয়তো হামি মরে যাবে, হামি বাঁচবে না।
তারপর নেলি বুঝল তার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা—অনিচ্ছার কথা নেই এখন। এটা তার শরীরের ইচ্ছা, সে ইচ্ছার দুঃসহ যন্ত্রণায় মাচান থেকে নেমে দুঃখবাবুর ঘরের দিকে হাঁটছে। তখন হরীতকীর ঘরে আঁধার। নেলির ঘরে কোনো লম্ফ জ্বলছে না। চটানে আঁধার। চটানে কোনো মরদের সাড়া নেই। মেয়ে মরদ বিহীন এই চটানে নেলি যেন ভূতের মতো হাঁটছে। কুকুর দুটো পিছনে আসছে। নেলি ওদের ইশারা করল চলে যাওয়ার জন্য। কুকুর দুটো আঁধারে নেমে গেল। শ্মশানের চালাঘরটায় হারিকেন জ্বলছে। কুকুর দুটো নিচে নেমে চিৎকার করল। বাবলার ঘন বনের দিকে ওরা যেন ছুটে গেল তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু রাতের শব্দ, রাত—পোকার শব্দ। কিছু ঝিঁঝিপোকার শব্দ অথবা যন্ত্রণার শব্দ। কাঠগোলায় কারা যেন হুড়মুড় করে সব কাঠ ফেলে দিল। নেলি দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্তর্পণে কাঠগোলার দিকে তাকাল—কেউ সে—ঘর থেকে নেমে আসছে কিনা দেখল। কেউ আসছে না। শুধু একটা কুকুর কাঠগোলা থেকে ছুটে পালাচ্ছে। কুকুরটা কাঠগোলায় যেন ভূত দেখেছে। তখন নেলির পায়ের ওপর আলো। দুঃখবাবুর ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে নিচে নেমেছে। সে দুঃখবাবুর ঘরের খুব কাছাকাছি এসে গেল। আলোটা ওর পা থেকে বেয়ে কোমরে উঠল। নেলি ওপরে উঠে জানালাটা একটু ঠেলে ঘরের ভিতরটা দেখল। লতুনবাবু লেপ দিয়ে শরীর মুখ ঢেকে রেখেছেন। আলোটা পাশের একটা তাকে জ্বলছে। নেলি এবার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। এবং ধীরে ধীরে ঠেলে দিতেই দেখল দরজাটা খুলে যাচ্ছে। অথচ নেলি দরজাটা বেশি দূরে ঠেলে দিতে পারল না। সে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে দরজার পাশে বসে পড়ল। মনে হল দুঃখবাবু এক্ষুনি হাজার লোককে ডেকে বলবেন ডাইনি মাগি আমাকেও খেতে চাইছে।
দুঃখবাবু ঘরে ঘুমোতে পারছিলেন না। চটানের প্রথম রাতযাপন তাঁকে মনের দিক থেকে বিব্রত করে মারছে। তিনি শুয়ে শুয়ে নেলির কথাই ভাবছিলেন। নেলির অসহ্য চোখ দুটো শরীরে দুরন্ত যন্ত্রণার জন্ম দিচ্ছে। বাসি কাপড়ের মতো স্ত্রীর শরীরটা মনের দড়িতে ঝুলছে। তিনি চোখ বুজে পড়েছিলেন শুধু। নেলি এই চটানে আছে। মাচানে নেলি, নেলি, এই ভাবনা শুধু মনে। বিকেলে এ—ঘরে নেলি না এলেই যেন ভালো করত। কিন্তু মনে হচ্ছে দরজাটা কে যেন ঠেলে দিল। মনে হচ্ছে দরজার ও পিঠে কে বসে হাঁপাচ্ছে। চোখ বুজেই তিনি যেন সব টের করতে পারছেন। তিনি ডাকলেন, কে বাইরে? কে দরজাটা ঠেলছিস?
তিনি দরজার ও—পিঠ থেকে কোনো জবাব পেলেন না বলে উঠে বসলেন। চোখ মুখ ঘষলেন। ভাবলেন মনের বিভ্রম হয়তো। তিনি শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ফের। কিন্তু শুয়ে পড়ার সময় দেখলেন দরজাটা সত্যি একটু খোলা। ভাবলেন হয়তো বাতাসে। তিনি উঠে দরজা বন্ধ করতে গিয়েই দেখলেন বাইরে নেলি চুপচাপ বসে আছে। বসে বসে যেন শীতে কাঁপছে।
তিনি বললেন, কিরে ভয়ে চটানে ঘুমোতে পারলি না বুঝি? আয়, আয়, ভিতরে আয়। ভিতরে বসবি। বাইরে খুব ঠান্ডা।
নেলি উঠে দাঁড়াল। বাবুর কথা শুনতে হয়, সুতরাং সে ঘরে ঢুকে গেল। এখন আর যেন নেলির কিছু করণীয় নেই। আবার বাবু যদি কিছু বলে, যদি বলে বোস, তবে বসবে। যদি বলে দাঁড়া তবে দাঁড়াবে। যদি বলে অন্য কিছু—তবে, তাই হবে। দুঃখবাবুর কাছে এখন নেলি কাঠের পুতুলের মতো হয়ে বাঁচতে চাইল।
সে সময় সহসা বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে। জানালায় বিদ্যুতের ছটা এসে নামল। ওদের মুখ উজ্জ্বল হল। শীতের শেষে ঝড়বৃষ্টি হবে। দুঃখবাবু জানালা বন্ধ করে দিলেন। সহসা মনে হল আকাশ কেঁপে উঠছে। অন্ধকারে বাইরের আকাশটা যেন ছাদের মাথায় ভেঙে পড়ল। দুঃখবাবু ভয় পাওয়ার মতো করে বললেন, কোথাও বাজ পড়ল নেলি। নেলি কাঠের পুতুল বলে জবাব দিতে পারছে না। আবার তেমনি আকাশ ভেঙে পড়ার শব্দ। জোর হাওয়া দিচ্ছে। দরজা জানলা কাঁপছে। বৃষ্টির ভয়ানক ছাট আসছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেয়াল বেয়ে জল মেঝেতে নামল। মেঝেতে জমল। তারপর মনে হল জানালায় কারা যেন ধাক্কা মারছে। যেন লাঠি পিটছে। অথবা কারা যেন জানালায় হাত দিয়ে শব্দ করছে এবং ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে এমন ভাব দেখাচ্ছে। দুঃখবাবু জানালা খুলে বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে দেখার জন্য ফাঁক করতেই এক পশলা শিলাবৃষ্টি হল ভিতরে। তিনি বুঝলেন বাইরে ভয়ানক শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। নেলিকে বললেন, তুই তক্তপোশে উঠে আয়। জলে দাঁড়িয়ে কষ্ট পাচ্ছিস কেন? তক্তপোশে বসে থাক, জল ছাড়লে ঘরে যাবি।
নেলি শীতে কাঁপছিল অথচ কিছু বলছিল না। দুঃখবাবু চাদরটা দিলেন ওকে। নেলি চাদরটা গায়ে দিল না, জবুথবু হয়ে তক্তপোশের এক কোণায় খুব আলগা হয়ে বসে থাকল। মেঝেতে জল ক্রমশ উপচে পড়ছে। শীতে কনকন করছে পাটা। নেলি তবু পা তুলে বসল না।
দুঃখবাবু ভাবলেন ধমক দেবেন। শাসন করবেন। নেলি এটা ভালো হচ্ছে না। আমার কথা অমান্য করতে নেই। তক্তপোশে পা তুলে বোস। চাদরটা গায়ে দে। শীতের ঠান্ডা কাউকে রেহাই দেয় না। তোকেও দেবে না, তুই শীতের ঠান্ডায় মরবি। অথচ তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। গলাটা কেমন কাঠ—কাঠ। গলাটা শুকনো। নেলি সেই যে পুতুলের মতো বসে রয়েছে, সেই যে ঘরে ঢুকে চুপ করে গেল—সেই যে ভাব, যদি বলে দাঁড়া, —তবে দাঁড়াবে, সে ভাব কিছুতেই যেন কাটিয়ে উঠতে পারছে না। দুঃখবাবুর শীত করতে থাকল। তিনি একটা কাঁথা জড়িয়ে বসলেন। এমন সময় প্রচণ্ড হাওয়ায় জানালায় একটা পাট খুলে গেল। আলোটা নিভে গেল। দুঃখবাবু জানালার পাশে ছুটে গেলেন। জানালাটা বন্ধ করার সময় শিলাবৃষ্টিতে ওর চোখ—মুখ ভিজে গেল। শরীরটা ভিজে গেল। অন্ধকারে তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তক্তপোশ ধরে ধরে চলছেন। তবু আন্দাজে নেলির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।—চাদরটা দিবি? মুখ মুছব। চাদরটা নেওয়ার সময় তিনি নেলিকেও টেনে তুললেন।