নেলি ভেংচে উঠল। হাত পা নেড়ে বলল, বাপরে! হামার বাপ! বাপের মুরদ দেখলে বাঁচিনে!
গোমানি ওর ভোঁতা দা—টাকে মাচানের নিচে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাঁড়ি টেনে কলসি টেনে দা—টা খুঁজছে। দা—টা ওর এ—মুহূর্তে চাই—ই। খুন সে যেন করবেই। নেলিকে খুন না করে জলগ্রহণ করবে না—এমন ভাব চোখে—মুখে। নেলি কিন্তু নড়ছে না। মেঝেতে দাঁড়িয়ে বাপের কাণ্ড দেখছে। আর যখন দা পেয়ে গোমানি ওর সামনে দা—টাকে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করল—খুন, খুন, আজ খুন হবে লিশ্চয়, তখন নেলি গলার স্বরটা শক্ত করল এবং পরে কোমল করে বলল, চুপ কর, চুপ কর। অমন করে ছোটলোকের মতো চিল্লাস না। যা খাচ্ছিস তাই খা, পয়সা না থাকলে দি কোত্থেকে!
গোমানি দেখল ঠোঙায় মুড়ি প্রায় নেই। সুতরাং সে নেলির মুখে ঠোঙাটা ছুঁড়ে দিল। —আর খাব না। তুর গতরের রোজগার হামার লাগে না।
গোমানি ফের মাচানে উঠে কাঁথা—কাপড় গায়ে দিয়ে বসে থাকল। যেন সে এ—মাচান থেকে আর উঠবে না, নড়বে না। অনড় হয়ে বসে থাকবে। হাসপাতালে যাবে না। কোথাও যাবে না। কোথাও না। নেলি হাঁটু গেড়ে মাটি থেকে একটা করে মুড়ি কোঁচড়ে তুলছিল তখন। একটা দুটো করে মুখে মুড়ি ফেলছিল। এই দুঃসহ দুঃখে বাপের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। ক্ষোভে চোখ থেকে জল বের হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে। এবং এ—সময়ই নেলির গেরুর মুখ মনে পড়ছে। জোয়ান শরীরটার কথা মনে পড়ছে। কৈলাস ডোমের বেটা দিন দিন চটানে মরদ হয়ে উঠছে। বাপের মতো কসরত দেখাতে শিখেছে। বল্লম ছুঁড়ে গাছ এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আকাশ ফুটো করে দেওয়ারও ইচ্ছা যেন গেরুর।
মাচানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল গোমানি। রাগ পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু নেলির হাবভাব দেখে মনটা ওর ফের বিগড়ে গেল। নেলি পিঁয়াজি খাচ্ছে—আহা পিঁয়াজি খাচ্ছে—যেন কিছু খায় না। যেন গোমানিকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়া হচ্ছে। যেন বলছে খেতে খেতে তোর কামাই খাচ্ছি নারে, আমার মুরদের কামাই খাচ্ছি। তবে এত ডর কীসের।
থুঃ থুঃ! গোমানি থুথু ছিটাল। —না আর খাব না। তোর গতরের রোজগার হামার লাগে না। যেন পারলে এক্ষুনি উগরে দেয় সব। বাপের এইসব কাণ্ড দেখে নেলি খিলখিল করে হেসে উঠল। না হেসে পারল না। না হাসতে পারলে খালি পেটে খিল ধরে যাবে যেন। উঠোনে নেমেও সে হাসল। পাগলের মতো হাসতে থাকল। মুখে বাপের থুথু লেগে আছে, মুড়ির কুচি লেগে আছে—সব মিলে ভীষণ একটা দুর্গন্ধ। নেলি হাতমুখ ধুল মালসার জলে। ফের হাসতে গিয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে সিপাহি। নেলি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। ছুটে এসে ঘরে ঢুকল সে।
হরীতকী গোমানির এই সব কাণ্ড দেখে বলেছিল—তুমি একটা বাপই বটে গোমানি।
হে বাপই বটে! গোমানি মাচানে বসে জবাব দিয়েছিল।
এটা বহুত আচ্ছা কাজ হল না। মেয়েটা ভি না খেয়ে রয়েছে, ওয়াকে তুমি খেতে দিলা না।
গোমানি একটা কোঁত গিলল।
গোমানির সওয়াল শুনল নেলি। সিপাহি উঠোন পার হয়ে গোমানির খোলা ঘরটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর জুতোর শব্দে মুখ তুলল গোমানি। সিপাহিকে দেখে খুব ভালোমানুষ হয়ে গেল। যেন এতক্ষণ চটানে কিছুই হয়নি। সে হাসল পুলিশ দেখে।
নেলি সিপাহিকে একটা পিঁড়ি দিল বসতে।
সিপাহি বলল—হে গোমানি চলেহ।
হা জি চলতে রহেহ। গোমানি কাঁথা বালিশের নিচে এখন গামছাটা খুঁজছে। —কাঁহাসে লাশ এল?
মধুপুরসে। সিপাহি পিঁড়ি টেনে বসল উঠোনে।
গোমানি কাঁথার ভিতর থেকে গামছা টেনে বের করল। —খুনের লাশ না গলায় দড়ির লাশ। মাথায় কাপড় দিয়ে ফেট্টি বাঁধার সময় এই ধরনের একটা প্রশ্ন করল সিপাহিকে।
সিপাহি দেখে গোমানির শরীরের সব জড়তা ভেঙে যাচ্ছে।
নেহি, পানীসে ডুবল জোয়ান মেয়ে।
পেটে বাচ্চা আছে জরুর।
সে বাত ত গোমানি তুম জানবে।
গোমানি গামছা কোমরে বেঁধে উঠোনে নামল। চালাঘরে দুটো মোরগ ডাকছে। একদল কাক হল্লা করছে পুরোনো অশ্বত্থ গাছে। চটান ছাড়িয়ে একটা দেওয়াল অতিক্রম করে বড় বাড়ির দোতলায় রেডিয়ো বাজছে। উড়োজাহাজের শব্দ আকাশে। ঝাড়ো ডোমের বৌ চেলাকাঠ ভাঙছে ওর মেজোবেটার পিঠে। গোরুর গাড়িগুলো চটান থেকে নেমে যাচ্ছে! ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছেন। ঘাটে মড়া আসেনি। কাউন্টারের সামনে কোনো লোক দাঁড়িয়ে নেই। আকন্দ গাছের ডাল বেয়ে রোদ উঠে যাচ্ছে। গোমানি চটান ছেড়ে শিবমন্দিরের পথে পড়ল।
গোমানিকে চলে যেতে দেখে নেলি ডাকল—বাপ!
ফের পিছু ডাকলি!
ঘরে কিছু লেই বাপ! ও বেলায় খাবি কী? তু জলদি আওগে ত।
আওগে। আওগে। খাব, ঠিক খেয়ে লিব। লেকিন তু কোথাও যাস না। দিনকাল বহুত খারাপ। গোমানি শিবমন্দিরের পথ ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়ল।
নেলি চলতে থাকল। সঙ্গে গঙ্গা যমুনা চলছে। চটানে নেলিকে ধমক দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। সে এখন একটু ঘুরবে ফিরবে। সে এখন পাশাপাশি সব চালাঘরগুলোতে উঁকি দেবে। ওদের রান্নার কথা শুনবে, ঘরে ঘরে শুধাবে ওরা বিকেলে কী খাবে। সে—সব শুনে সে বিষণ্ণ হবে। পেটের যন্ত্রণাটা তখন আরও বাড়বে।
নিজের কথা ভাববার সময় গঙ্গা যমুনার কথা মনে হল। গঙ্গা যমুনাকে এখনও পর্যন্ত কিছু খাওয়াতে পারল না। গঙ্গা যমুনা পায়ে পায়ে ঘুরছে, খেতে চাইছে। আজ এখনও ঘাটে মড়া আসেনি। রাতের বুড়ো মানুষটার নাভিটা নিশ্চয়ই কচ্ছপেরা শেষ করে দিয়েছে। গঙ্গা যমুনা বিরক্ত করছে ত করছেই। নেলি অগত্যা বলল, লে—লে—খেয়ে লে। হামার গতরটা খেয়ে লে। এই শুনে কুকুর দুটো কী বুঝে ছুটতে থাকল। নেলিও ছুটল কুকুর দুটোর পিছনে। গঙ্গার পাড় ধরে ওরা ছুটছে। নেলির ইচ্ছা, এ—সময় গেরু আসুক, ওরা একসঙ্গে ঘাটবন্দরে উঠুক। তারপর আরও দূরে আরও দূরে। সেখানে বুড়ো মানুষটার জন্যে আতপ চাউল সিদ্ধ হচ্ছে, কিছু তন্ত্র—মন্ত্র হচ্ছে তারপর ডেলা ভাতগুলোতে কিছু কালো তিল মিশিয়ে বুড়ো মানুষটার বেটারা গঙ্গার জলে ভাসাবে। নেলি সব খবর রাখে। নেলি সেই উদ্দেশ্যেই আপাতত হাঁটতে থাকল।