আপনি টুলটার ওপর উঠে বসেন, হামি ঝাড় দিয়ে লিচ্ছি।
ইতিমধ্যে ঘাটোয়ারিবাবু দুঃখবাবুর জন্য একটা ছোট পুরনো তক্তপোশ জোগাড় করে দিয়েছেন। ঘরের একপাশে সেটা পাতা আছে। নেলি নুয়ে প্রথম তক্তপোশের নিচটা পরিষ্কারের জন্য গলা বাড়ালো। নেলি তক্তপোশের নিচেটা ঝাঁট দিচ্ছে—দুঃখবাবু দেখতে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। নিজের স্ত্রীর কথা মনে হল। ঘরে ওর স্ত্রী আছে। সতীসাধ্বী স্ত্রী। সুতরাং মনের দুর্বিনীত ইচ্ছাটাকে দমন করতে চাইলেন। বিবাহিত পুরুষের এমন ইচ্ছা ভালো নয়। তিনি টুলে বসে আহ্নিকের মতো জপ—তপ করতে থাকলেন—বিবাহিত পুরুষের এমন ইচ্ছা ভালো নয়। ভালো নয়। শেষে কেন জানি তিনি নেলির ওপর বিরক্ত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, নেলি, তুই একটা ব্লাউজ পরতে পারিস না? তোর বাপকে বলবি তুই বড় হয়েছিস। একটা জামা যেন তোকে কিনে দেয়। কথাগুলো দুঃখবাবু ধমকের সুরেই বললেন।
নেলি লজ্জায় মাথা তুলতে পারল না।
তখন সূর্য পুরনো অশ্বত্থের ডাল বেয়ে নদীর ওপারে নামছে। যে রোদ জানলা বেয়ে মেঝেতে নেমেছিল সে আবার দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছে। লাল রঙ ধরেছে। পৃথিবীর সর্বত্র আলো। আলোর রঙ। লাল নীল হলুদ আলো। আকাশ নীল। সাদা মেঘ। টুকরো টুকরো সাদা মেঘের রঙ আকাশে কুর্চি ফুল ফুটিয়েছে। বিকেলের সাদা মেঘ সোনালি রঙে জ্বলছে। নেলি জানালায় মুখ রাখতে পারল না। একটা ব্লাউজের অভাব এই ধরণির সব সুখকে বিষময় করে তুলল। ঘরটা পরিষ্কার করে সে কোনোরকমে বাইরে এসে দাঁড়াল। সূর্যের সোনালি আলো ওর শরীরে এসে নেমেছে। দুঃখবাবু দেখলেন—নেলি সে আলোয় জ্বলছে। নেলির মুখ, চোখ, শরীর এই আলোর অসামান্য লাবণ্যে বড় মনোরম হয়ে উঠছে।
দুঃখবাবু ডাকলেন, কিরে রাগ করলি?
নেলি জবাব দিল না।
সহজ হবার জন্য দুঃখবাবু বললেন, তোর বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করবি না? তোর বিয়েতে কিন্তু দেখিস যেন বাদ পড়ি না। কিরে, কথা বলছিস না কেন? মনে থাকবে তো আমার কথা?
মনে থাকবে। লেকিন শাদি আমার হবে না বাবু।
কে বললে হবে না? জরুর হবে। আমি দেখে শুনে তোর শাদি দেব!
কাঁহা দিবি বাবু? কোন হামারে শাদি করবে?
সবাই করবে। কাটোয়ার চটান থেকে তোর জন্যে মরদ ধরে আনব।
লেকিন হবে না।
কেন হবে না।
চটানের লোকেরা বুলবে হামি ডাইনি আছি। দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছি। আপনি তু লতুনবাবু আছেন। দুরোজ থাকেন, সব টের পাবেন।
নেলি নেমে যেতে থাকল অফিসঘরের বারান্দা থেকে। দুঃখবাবু ফের ডাকলেন। নেলি দাঁড়াল না। বাবুর কথাগুলো ওর শরীরের আগুনটাকে আরও খুঁচিয়ে দিয়েছে। সে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকল। নিচে নেমে সে কাউকে না দেখে গঙ্গা—যমুনাকে ডাকল। শেষে চটানে উঠে হরীতকীকে বলল, রাতে তু কিছু না রাঁধবি পিসি। হামি আজ রাতে বুড়াবাবার ঘরে যাবে। আজ তু, হামি—দুটো ভালো মন্দ খেয়ে লিবে।
সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নেলি গঙ্গা—যমুনাকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে ছুটতে থাকল। নদীর পাড়ে রাত ঘন হয়ে নামছে। ঘন অন্ধকারে জোনাকি জ্বলচে। নিচে বালিয়াড়িতে কাঁচা কয়লা পুড়ছে। নেলি ছুটতে থাকল কেবল। কুকুর দুটো ছুটছে। শিমুল পলাশের অন্ধকার অতিক্রম করে নেলি সেই বুড়োর বাড়িটার পাশে একটা ঝোপের ভিতর কুকুর দুটোকে নিয়ে লুকিয়ে থাকল। বুড়োর ছেলে দুটো আসছে। কিছু মেয়ে—পুরুষ সঙ্গে। পুকুর পাড়ে পেয়ারা গাছের নিচে ওরা প্রদীপ রাখল। ওরা পেয়ারা গাছটার নিচে বুড়োর আত্মাকে খেতে দিল। নেলি ঝোপের ভিতরে বসে সব দেখছে। গঙ্গা—যমুনাও দেখছে। পেয়ারা গাছটার নিচে মালসাতে খেতে দিয়ে বুড়োর ছেলেরা কাঁদল। মেয়েরা কাঁদল। তারপর ওরা চলে গেল। বুড়োর আত্মাকে শেষবারের মতো খেতে দিয়ে ওরা বাড়ির ভিতর ঢুকে সদর বন্ধ করে দিল। শুধু যারা বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিল তারা দেখেছিল প্রথম একটি মেয়ের রূপ ধরে আত্মাটা খাবারগুলো খেল পরে দুটো কুকুরের শরীর নিয়ে আত্মাটা খাবারগুলোর আশেপাশে ঘুরে বেড়াল। এক সময় পেয়ারা গাছের নিচে প্রদীপটা নিভে গেল।
নেলি সে রাতে ঘরে ফিরে বলেছিল, পিসি তু আর হামি খাবে। খাওয়ার পর ঢেকুর তুলে বলেছিল, বেশ খেলাম নারে পিসি। তু ভি খেলি হাম ভি খেলাম। গঙ্গা—যমুনা ভি খেল। বুড়োটার খুব চিংড়ি মাছের মুড়ো ভাজা খাওয়ার শখ। সব দে লিছে পিসি। ওর বিটিরা কাঁদছে কী পিসি! বুলছে—বাবাগো তুমি চিংড়ি মাছ খেতে ভালোবাসতে গো। বাবাগো তোমাকে দেখতে নারলেম গো। কী কাঁদছে পিসি। ওয়ার বেটারা পিসি আচ্ছা নকরি করে।
নেলি খেয়ে উঠে বলল, হামরাও একটা ভোজ খেয়ে লিলাম পিসি। আচ্ছা ভোজ।
হরীতকী বলল, ভাত, দাল, মিষ্টি, রসগোল্লা। মাছের কালিয়া। কত হরেকরকম খাবার খেয়ে লিলুমরে। গেরুর ভোজের চেয়ে এটা কম হল না। কী বলিস তু?
অথচ ঘুরে ফিরে সেই এই আপশোশ নেলির। যত জিয়াগঞ্জের চটানের কথা মনে পড়ছে তত কষ্ট বাড়ছে। এখন হয়তো শনিয়ার শরীরটা গেরুর শরীরের সঙ্গে মিলে আছে। বাপ গোমানি মদ খেয়ে হয়তো হল্লা করছে। কৈলাসের হাঁক—ডাকে হয়তো গোটা চটানটা কাঁপছে। মংলি মরদের সঙ্গে হয়তো বালিয়ারিতে নেমে গেছে। যতরকমভাবে হতে পারে—সব রকমের ফুর্তি করছে। নেলি নিজের ঘরে ঢোকার সময় এমন সব ভাবল। এমন সব ভাবায় চোখে—মুখে জ্বালা ধরছে। সে বিছানায় শুয়ে শরীরটাকে শক্ত করে দিল। গায়ে কাঁথা—কাপড় টেনে পায়ে পা ঘষতে থাকল। উপুড় হয়ে পড়ে চাপ দিতে চাইল শরীরে। শরীরে তার গরম ধরে গেছে। ইচ্ছার আধারগুলোতে দুঃখবাবু অথবা গেরুর প্রতিবিম্বকে দেখতে চাইল। গেরুর চেয়ে দুঃখবাবুর প্রতিবিম্ব ওকে বেশি তাড়না করছে। অথবা নেলি সেই প্রতিবিম্বকে ভালোবাসতে চাইছে। গেরুর ওপর বদলা নিতে চাইছে। সুতরাং নেলিও সেই প্রতিবিম্ব নিয়ে যতরকমভাবে হতে পারে শরীরের ওপর লুফতে থাকল কিন্তু এই করে গতরে উত্তেজনা শুধু জমছে। গরম বাড়ছে। গভীর রাতে দুঃখবাবুর ঘরের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। নেলি শক্ত হয়ে শুয়ে থাকল মাচানে। মাচান ধরে পড়ে থাকল। শরীরের চাপ মাচানে সেজন্য বাড়ছে। কাঁথা—কাপড়ের ভিতর মাচানের শব্দ উঠছে। সে কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারছে না। কিছুতেই নিজেকে আর যেন ধরে রাখতে পারছে না। আর পারছে না। পারছে না। সে উঠে বসল। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে শরীরে ভীষণ জ্বর এসেছে। অথবা বেতো রুগির মতো কেমন এক অলস যন্ত্রণায় ভুগছে। মাচানের ওপর বসে সে যেন বুঝল শুধু প্রতিবিম্বকে নিয়ে শরীরের গরম মেটে না। এতে শরীরের যন্ত্রণা আরও বাড়ে। নেলি নিজের কাছেই খুব অসহায় হয়ে পড়ল। যত ভাবছে উঠবে না, দুঃখবাবুর ঘরের দিকে যাবে না, ততই উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়ছে। অসহ্য মনে হচ্ছে এই মাচান। কপালে ঘাম জমেছে। শরীরের সব রক্তমাংস যেন জল হয়ে এক্ষুনি গলে পড়বে। নেলি মাচানে বসে অন্ধকারে দু—হাত উপরে তুলে ডাকল, ডাকঠাকুর, তু হামারে ভরসা দে।