গোরুর গাড়ি দুটো চটান থেকে নেমে গেলে নেলি হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল উনুনের পাশে। চটানে কেউ নেই, হরীতকী গোরুর গাড়ির সঙ্গে কিছুদূর নেমে গেছে। একমাত্র মংলি তাদের কাঠের দরজায় তালা দিয়েছে। অন্য সকলের দরজা নেই, তালাও পড়েনি। নেলি ঘর থেকে বের হয়ে চটানের চারপাশটায় হাঁটতে থাকল। সহসা একটা দুরন্ত ইচ্ছা নেলিকে পাগল করে তুলেছে। নেলিকে উত্তেজিত করে তুলেছে। এ—চটানে ওর জন্য কেউ ভাববার নেই, কী হবে এ—চটান দিয়ে কী হবে বাপ গোমানি, অন্য মেয়ের মরদ গেরুকে দিয়ে, কী হবে এ চটানে বেঁচে থেকে। তার চেয়ে সে অন্য কোথাও উঠে যাবে, অন্য কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধবে। সেইজন্যই দুরন্ত ইচ্ছাটা ওকে ঘোড়দৌড়ের মতো ছুটাল। ঘরে ঘরে আগুন ধরানোর জন্য নানারকম ফন্দি—ফিকির খুঁজতে থাকল। দরকার হলে সে—আগুনে পুড়ে মরবে। চটানে আগুন দেবার আগে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, কিছুক্ষণ আকাশ দেখল। দু—একবার প্রকট হাসিতে ফেটে পড়তে চাইল। অথচ আত্মহত্যার প্রবল ইচ্ছা নেলিকে হাসতে দিচ্ছে না। ক্রমশ বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে, ক্রমশ হাতে পায়ে শক্তি পাচ্ছে না, এমনকি দেশলাইটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি ধরাবার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। এত ভারী হয়ে গেছে শরীরটা, এত সে ভেঙে পড়েছে।
তখন দুঃখবাবু চটানে উঠে এলেন। চটানটা একেবারে ফাঁকা। কেউ নেই। এমনকি হরীতকীকে দেখতে পাচ্ছেন না। নেলিকে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি চটান অতিক্রম করার সময় ডাকলেন, নেলি আছিস নাকি রে ঘরে? নেলি, ও নেলি! চটান যে একেবারে ফাঁকা। হরীতকীও বুঝি গেছে! নেলি, ও নেলি, সাড়া দিচ্ছিস না কেন?
নেলি তাড়াতাড়ি দেশলাইটা লুকিয়ে ফেলল। ভেতর থেকে উত্তর করল এই যে বাবু আমি ঘরে। শরীর ভালো নেই বলে শুয়ে আছি বাবু।
কিছু করছিস না ত?
না বাবু, কিছু করছি না।
শরীর কী খুব খারাপ যাচ্ছে?
না বাবু।
ওরা তবে সব চলে গেল?
জী বাবু। নেলি আর শুয়ে থাকতে পারল না? খারাপ দেখাচ্ছে ভেবে নেলি তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বাইরে বের হয়ে এল। হাতে পায়ের জড়তা ভাঙবার মতো শরীর টান টান করল। গেরুর বিয়েতে সে এতটুকু ভেঙে পড়েনি, শরীর টানা দিয়ে এ—মত ভাব প্রকাশ করার ইচ্ছা—যেন ভাবটা—গেরু শাদি করতে গেছে, নেলি, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।
তা হলে তুই গেলি না?
না বাবু! যেতে ইচ্ছে হল না।
বসে থাকলি একা একা?
জী বাবু।
তবে আমার ঘরে আয়, কাজও করবি, গল্পও করবি।
দুঃখবাবু এবার অফিসঘরের দিকে হাঁটতে থাকলেন। বেলা পড়ে আসছে। দুঃখবাবু ঘরে ঢুকে জানলা খুলে দিলেন। শীতের পাখিরা জানালার আকাশে উড়ছে। পলাশগাছে ফুল ফুটছে। গাঙ শালিকেরা মধু খাচ্ছে পলাশ ফুলের। ওরা উড়ল। ওরা বসল। দুঃখবাবু জানালা খুলে সব দেখতে পেলেন। বাবলার ঘন বনে দুটো মেয়ে কাঠ সংগ্রহ করছে, দুটো কাঠঠোকরা পাখি, দুটো ইষ্টিকুটুম ওর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আকাশ ঘন নীল। চালা ঘরটায় ইতস্তত কুকুরের আর্তনাদ। বালিয়াড়িতে পায়ের ছাপ। হরীতকীর ঘরে বাচ্চাটা হাত—পা নেড়ে খেলছে। হরীতকী ফিরে এসেছে নদীর ঢালু থেকে। হরীতকী কত রকমের কথা বলল বাচ্চাটার সঙ্গে। দুঃখবাবু নিজের ঘরের কথা ভাবলেন। বৌ বাচ্চার কথা ভাবলেন। ভাবলেন অভাবের সংসার। সুখ—দুঃখের ঘর। ওদের মুখে দুটো অন্ন দেওয়ার জন্যই তিনি এখানে মরা মানুষের হিসাব আগলাচ্ছেন। কিন্তু এখানে এলেই মনটা ভারী হয়ে ওঠে। বুকে নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা—মৃত্যু, মৃত্যু। এই ভাব শুধু মনে। তবু আসতে হবে, বসতে হবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানে পড়ে থেকে মড়ার হিসাব আগলাতে হবে। এইসব ভেবে দুঃখবাবু কেমন মুষড়ে পড়লেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। তখন পাশে কেউ নেই যে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলে সাহস দেবে অথবা দুটো ভিন্ন রকমের কথা বলে মনের অস্বস্তি দূর করবে। তিনি ফের ডাকলেন, নেলি, ও নেলি। একবার আয়না বাপু। ঘরে একা বসে করছিসটা কী শুনি। এইসব বলে, ডেকে—হেঁকে নিজেই মনটাকে অন্যমনস্ক করতে চাইলেন।
নেলি ঘরে গিয়ে মাচানে বসে পড়েছিল। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গল্প করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবু বাবু ফের ডাকলেন। বাবুর কথা অগেরাহ্যিতে আনতে নেই। বাবু যখন ডেকেছেন, যখন এ—দুঃখ যাবার নয়, তখন দুটো ভিন্ন রকমের কথাই বলা যাক লতুন বাবুর সঙ্গে। সে মাচান থেকে উঠল—যেন আর কোনো দুঃখ নেই। কিছুক্ষণ আগেও আত্মহত্যার যে প্রবল ইচ্ছা ওকে তাড়না করছিল, নতুন বাবুর ডাকে সে ইচ্ছা আর সাড়া দিচ্ছে না। সেই দুরন্ত ইচ্ছাটাও নেই। বাবু ডাকছে। বাবুর ইচ্ছা ওর পাশে বসে সে গল্প করুক। নেলি নিজের শরীরটার দিকে চাইল। কদিনে শরীরটা আরও যেন বেশি ভারী হয়ে উঠেছে। কোমরের নিচটা ক্রমশ মোটা হচ্ছে। শরীরে মাংস লাগছে। ছোট কাপড়ে শরীর ঢাকছে না। সে নিজেই লজ্জা পেল শরীর ঢাকতে গিয়ে। তবু শরীর কোনোরকমে ঢেকে সে বাবুর ঘরে গিয়ে উঠল। দরজার ভিতরে উঁকি মেরে বলল—আমায় ডেকেছেন বাবু! কী কাজ করে দিব বুলে দ্যান।
দেখ না ঘরটা কেমন নোংরা হয়ে আছে। সেদিন ত ঘরটা পরিষ্কার করে দিলি। দ্যাখ আজই কী নোংরা হয়ে গেছে। দ্যাখ তক্তপোশে দেওয়ালের কেমন চুনবালি। মেঝেতে পা রাখা যাচ্ছে না। দে দে পরিষ্কার করে দে। ঘরটাতে বসতে পারছিনে।