রামকান্ত বলল—তোর বাপ চটানে আছে না হাসপাতালে গেছে?
চটানেই আছে। মাচানে পড়ে গোঙাচ্ছে।
ধারে টাকা নিল, টাকাও দিল না, সুদের নামও করল না।
করবে। হাতে টাকা হলে বাপ দিয়ে দিবে।
এবার গলা খাটো করল রামকান্ত। জোঁকের মতো গলা লম্বা করে দিল। এবং ফিসফিস করে বলল, হরীতকীর বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলেরে?
মেয়ে বাচ্চা দি লিছে পিসি।
তুই বাচ্চা দিবিনে? তোর বাচ্চা দিতে শখ যায় না?
নেলি বাবুর মুখ দেখে অর্থ ধরতে পারল। সে চোখ ঢাকল। মুখ কুঁচকাল। কিন্তু কিছু প্রকাশ করল না। রামকান্ত সুদের মহাজন—নেলি রামকান্তকে ঘাঁটাতে সাহস করল না। অথচ চোখে—মুখে অস্বাভাবিক ভাব নেলির। বিরক্তিতে চোখ দুটো জ্বলছে। তবু সে এতটুকু রাগ দেখাল না। নরম গলায় ঢুলে ঢুলে বলল, কী যে বুলছে বাবু!
এমন কথা শুনে অনেক দিন পর রামকান্ত প্রাণ খুলে হাসল। কী যে বুলছে বাবু! নেলির মা ফুলনও এ—গলায় এমনি করে বলত। এমনি করেই চোখমুখে অস্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে তুলত। তখন ফুলনের মুখটা আরও মিষ্টি লাগত। তখন ফুলনের ভরা কোটালের যৌবন। নেলিকে প্রশ্ন করার মতো সেদিন ফুলনকেও প্রশ্ন করেছিল—ঝাড়ো ডোমের বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলে? ডোমের বৌ বাচ্চা কেমন দিলে। তুই বাচ্চা দিবিনে, তোর মা হতে শখ হয় না?
তারপর একদিন চটানে শুনতে পেয়েছিল গোমানির পোয়াতি বৌর কান্না। মাচানের নিচে ফুলন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মেটে হাঁড়ি—কলসিগুলো নিচে থেকে সরিয়ে রেখেছে গোমানি। ঘাটের কাঁথায়—কাপড়ে মাচানের চারদিক ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মাচানের ওপর গোমানি নিশ্চিন্তে বিড়ি টানছে। সুদের মহাজন রামকান্ত চটানে এসে অপেক্ষা করছে। এ সময় গোমানির টাকার দরকার হতে পারে। টাকা দেওয়ার জন্য বসে রয়েছে সে। গোমানি তখন মাচানের ওপর ফকির দরবেশের মতো। গোমানি তখন ঈশ্বরকে ডেকে বলছে, দুনিয়া আজব জায়গা। এখানের জনম—মরণ রহস্য আমরা ছোট মানুষ হয়ে কী করে জানব। ওর আসমান ওর জমিন—ও ঠিক টেনেটুনে খালাস করবেই। মাঝে মাঝে গোমানি মাচানের নিচে উঁকি মারছিল আর দেখছিল—খালাস পাচ্ছে কী পাচ্ছে না, এবং ঝাড়ো ডোমের বৌকে বলছিল—ভাবি, টেনে নামাস না। ওকে আপনি নামতে দে।
সেই মেয়ে এখন এত বড় হয়েছে, সেই মেয়ে এখন কাপড় সামলে হাঁটে। সেই মেয়েকে সে অযথা এখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে চায়।
নেলি কিছু মুড়ি কিনল। কিছু পেঁয়াজি কিনল।
নেলি চটানে ফিরে এসে দেখল মাচানে তেমনি উপুড় হয়ে পড়ে আছে বাপ। বালিশের ভিতর মুখগুঁজে পড়ে আছে। হাত পা কুঁকড়ে রেখেছে। শরীরটা শুকনো লাউডগার মতো। গোমানি নেতিয়ে আছে মাচানে। মানুষটার পেটে রাজ্যের খিদে। নড়তে পারছে না—এ—পাশ ও—পাশ হতে কষ্ট।
নেলি সন্তর্পণে উঠোন পার হয়ে উঠল। মাচানে বসল। ধীরে ধীরে বাপের শরীর থেকে কাঁথা—কাপড় সরিয়ে ডাকল—বাপ, উঠরে বাপ। খা। দুটো দানা মুখে দেনেসে তাগদ হবে শরীরে। হাসপাতাল সে আজ জরুর সিপাই আওগে। তু খা লে।
গোমানি উঠে বসল। ওর পাতলা আমশি ঠোঁটে হাসি ফুটল। শেষে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে মুড়ির ঠোঙাটা জোর করেই যেন নেলির হাত থেকে কেড়ে নিল। তারপর মুঠো মুঠো মুড়ি কুমিরের মতো হাঁ করে মুখটায় ঠেলে দিতে থাকল এবং মুড়ি খেতে খেতেই গোমানি বলল—খুব তাল মুড়ি আছে। দুটো মুড়কি লিলে ভালো হত রে। লয় তো কিছু বেগুনি, ফুলরি।
লিয়েছি। এক আনার পিঁয়াজি ভি লিয়েছি। দ্যাখ কেমন গরম গরম আছে।
বাপের এই খুশি—খুশি ভাবটুকু নেলির ভালো লাগছে। নেলি আঁচলে গিঁট খুলে পেঁয়াজির ঠোঁঙাটা ওর হাতে দিল। —দেখ কেমন গরম গরম লিয়েছি। তুর চারঠো হামার চারঠো। মুড়ি সবটা খেয়ে লিস না আবার। হামার লাগি রাখিস। ভুখ হামর ভি লাগিছে।
নেলিকে খুশি—খুশি দেখে বিড়ি খাওয়ার জন্য গোমানি চারটা পয়সা চাইল। —চরঠো পয়সা জায়দা হবে?
নেলি ঘাড় নাড়ল। তারপর বাপের দিকে চেয়ে বলল—না।
গোমানির দাঁত না থাকায় কথা খুব অস্পষ্ট। মুখভর্তি মুড়ি থাকার জন্য কথা আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুড়িগুলো মাড়ি দিয়ে চিবুচ্ছে আর বলছে, চারঠো পয়সা জায়দা হোবে না বুলছিস। তবে চার পয়সার বিড়ি কিনে লিতাম।
নেলি দেখছে বাপ মুড়ি প্রায় শেষ করে এনেছে। একবার ওর কথা ভাবছে না। যেন সব মুড়ি, সবকটা পেঁয়াজি শেষ করে দেবে। যেন গোমানি একাই খাবে সব। বাপের এই অবিবেচনার জন্য নেলি বিরক্তিতে ভেঙে পড়ল। না হবে না। পয়সা হামার নেই। পয়সা পাব কুথা? দুচার পয়সা তু হামারে দিস?
তব তু এ—পয়সা কাঁহা পেলি? বুল শুয়োরের ছা, তু কুথা পেলি। গোমানি গলাটাকে ওঠাতে নামাতে থাকল।
পয়সা হামি কামিয়েছি। এ—মুড়ির পিণ্ডি যে তু গিললি সে হামার রোজগারের। লজ্জা না লাগে তোর মেয়েমানুষের রোজগার খেতে। পোড়া কাঠ খেতে পারিস না ঘাটের। পোড়া মানুষ চিবিয়ে খেতে পারিস না! নেলির মুখে গরল উঠল।
খুন! খুন করে দেব। গোমানি কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠে পড়ল। কোমর থেকে লুঙ্গিটা খুলে যাচ্ছিল, সেটা কোনোরকমে ধরে ফেলল। এক হাতে কোমরের লুঙ্গিটা চেপে ধরে মাচান থেকে লাফ দিয়ে নামল। সে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। মাচানের নিচে গলা বাড়িয়ে সে খুঁজছে দা—টা। মুড়ির ঠোঙা এক হাতে—সেটা ছাড়ছে না। মাচানের নিচে থেকে গলাটা ফের কচ্ছপের মতো বের করে ধরল। কচ্ছপের মতো চোখ করে সে নেলিকে দেখছে—খুন করে দেব বেইমানের ছা! আমি না তোর বাপ!