যাত্রীরা সব উঠে যাচ্ছে। ওরা ডুব দিয়ে সাঁতার কাটছে এবং গঙ্গার বুক থেকে মাটি, কাঁকর, বালি খড়কুটো সব তুলে আনছে। গেরু অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে। বালির ওপর মাছের মতো খুঁটে খুঁটে চলতে পারে—নেলি জলের ভিতর থেকে সব দেখতে পাচ্ছে। জলের ভিতর দিয়ে গেরুর পেশী বড় মজবুত লাগছে। কোমরটা সরু লাগছে। বুকের পেশীগুলো শক্ত মনে হচ্ছে। গেরু অনেকক্ষণ জলের নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে। মাছ হয়ে ভাসতে পারে। গেরুর নসিব ভালো—সে একটা একটা দুটো পয়সা পেল। তামার পয়সা। সে এক আনা পেল। নেলিও ডুব দিয়ে দিয়ে জল কাটছে। আঁচলটা বুক থেকে নেমে মাছের পাখার মতো কাঁপছে। নেলি জলের নিচে দেখল গেরু পয়সা খুঁজছে আর ওর দিকে যেন তাকাচ্ছে। নেলি এসময় এক আনা পেল, গেরু রে, তু আরও দেখ, যত পারিস দেখ। নেলি ডুব দিয়ে দিয়ে চোখ লাল করছে যদি নসিব খোলে। যদি সোনাদানা উঠে আসে আবর্জনার সঙ্গে। দাঁতে দাঁতে ঠেকল। সে ডুব দিল। এত করেও সে যখন পাচ্ছে না, যখন লখি, টুনুয়া সোনাদানা পেল যখন সকলে খুশি হয়ে উঠে যাচ্ছে, তখন নেলি গাল দিল—ডাক ঠাকুর তোর মুখে আগুন।
জল থেকে নেলি উঠে এল। গেরু উঠে এল। উত্তরের হাওয়া আরও বাড়ছে। নেলি শরীর সামলে নিল এবং বলতে ইচ্ছা হল, গিল কাল হামি ভুখা থাকলে গেরু। তুর চারঠো পয়সা হামারে দিয়ে দে। দু আনায় মুড়ি পিঁয়াজি কিনেলি। দুটো হামি খাই, দুটো বাপ ভি খাক। কিন্তু নেলি বলতে পারল না—জলের নিচে যে ইচ্ছার রঙে ডুবেছিল, উপরে উঠে সেই ইচ্ছাই ওকে বলতে দিল না। গেরুর দিকে তাকাল এবং নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে উপরে উঠতে থাকল। বলতে থাকল যেন—গেরুরে, তু বহুত জোয়ান হয়ে উঠেছিস। উপরে উঠে টুনুয়াকে ডাকাল, এ টুনুয়া শোন। টুনুয়া কাছে এলে বলল, চারঠো পয়সা ধার দিবি। কাল হামি ভুখা থাকল, বাপ ভুখা থাকল।
টুনুয়ার কাছ থেকে চারটা পয়সা নিয়ে ফের ছুটতে থাকল নেলি। কাপড়ের আঁচলে পয়সা দু আনা শক্ত করে বেঁধে শিবমন্দিরের পথে উঠতে থাকল। আকাশটা পরিষ্কার। প্রচণ্ড শীত যেন আকাশ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাপড় নিংড়াল নেলি। দুপুর হচ্ছে অথচ রোদের উত্তাপ বাড়ছে না। নেলি গায়েপিঠে উত্তাপ নিয়ে শরীরে উত্তাপ জমাতে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে চটানের দিকে নেমে গেল। ঝাড়ো ডোম গাওয়াল করতে বের হচ্ছে—লাঠির দুপাশে ডালা—কুলো ঝুলছে। সোনাচাঁদ শহরের কুকুর বেড়াল ফেলতে মিউনিসিপাল অফিসে যাচ্ছে। দুখিয়া হল্লা করছে চটানে। নেলি চটানে না ঢুকে পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে শুনল সব। দুখিয়া নালিশ দিচ্ছে গোমানিকে—তেরে বেটি চোর গোমানি। তেরে বেটি চোর। সাবধান করে দিস বেটিকে।
পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে নেলি বুঝল বাপ উত্তর করছে না। এখানে দাঁড়িয়ে অন্তত কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাপের চেহারা এ সময় কেমন দেখাচ্ছে এই ভেবে নেলি মুষড়ে পড়ল। ভাবল, এখন চটানে উঠে গেলে বাপ হয়তো চেলা কাঠ নিয়ে তেড়ে আসবে। বলবে, হারাম তু চটানসে নিকাল। নেলি সুতরাং নড়ল না। আরও কিছু কথাবার্তা না শুনে সে নড়তে পারছে না। বাপের আওয়াজ কানে আসার আশায় পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। শীতে কাঁপল। কারণ আওয়াজ শুনলেই সে বুঝতে পারবে বাপের রাগ চেলাকাঠের না দু দণ্ড গালমন্দের। নেলি শুনল তখন বাপ বলছে—চোর! মেরে বেটি চোর!
হা জরুর চোর। তেরে বেটি চুরি করে লিছে ঘাটের কাপড়। বে হুদা হামার ডাক হল। তু কিছু করে না লিস ত পাঁচ জনকো হাম জরুর সালিসি মানে।
তু সালিসি না মানে দুখিয়া। ও আর ঘাটসে কিছু লেবে না। আমি ওয়াকে বারণ করে দেব।
নেলি বাপের এইসব কথাগুলো শুনে নিশ্চিন্ত হল। চটানে উঠে গিয়ে মাচান থেকে কাঁথা—বালিশের ভিতর থেকে একটা শাড়ি বের করল। ভিজে শাড়িটা এবং কাঁথাটা চালের ওপর ফেলে দিল। এ সময় হরীতকী দরজা থেকে মুখ বের করে দেখল দুখিয়া নেই—চলে গেছে। নেলি কাপড় ছাড়ছে, কাপড়ে বুক ঢাকতে চায় না। হাঁটু ঢাকতে চায় না। তবু নেলি কাপড়টা টেনেটুনে সব শরীরে পেঁচিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সব দেখে হরীতকীর কষ্ট হল এবং হাতমুখ নেড়ে ভিতরের কষ্টটাকে উগরে দিল—চামার! চামার! ছোটলোক!
গোমানি কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে সম্মতি জানাল, ছোটলোক—হা ছোটলোক বটে।
হরিতকির মনের ঝাল যেন মিটছে না।—ঘাটের কাপড় না বুলে লিয়েছে ত ওয়ার জান গেছে!
হা তাই বটে।
চুরি করে লিছে ঘাটের কাপড়! এর নাম চুরি! আর বুলি গোমানি বেটিকে কাপড় দেওয়ার মুরদও নাই তোমার। ঘাট থেকে চুরি করে তবে ওয়ার পিনতে হয়।
নেলি পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে বাপের শেষ জবাবটাও শুনে গেল। —নাই আমার, হা নাই যা বুলছ।
নেলি চটান পার হয়ে শিবমন্দিরের পথ ধরল। সে শরীর ঢেকে গা বাঁচিয়ে হাঁটছে। সে জানে কেউ ওকে ছোঁবে না। সে জানে ছুঁয়ে দিলে ওরা স্নান করবে গঙ্গায় এবং নেলির চোদ্দপুরুষকে উদ্ধার করবে। নেলি রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটল। বাবুদের দেখে আলগা হয়ে দাঁড়াল। নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে শরীর আলগা করে দিল। জড়োসড়ো হয়ে সকলকে পথ খুলে দিল।
নেলি রামকান্তর দোকানে এসেও আলগা হয়ে দাঁড়াল।