নেলি চলে যাচ্ছে। চলে যেতে যেতে থামল। আঁচলটা টেনে কাঁধে ফেলল। চোখ টান করে, ঘাড় কাত করে তাকাল বাপের দিকে। তারপর ফের চলতে চলতে উঠোনে নেমে গেল। নিচে নেমে শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিল—টঙ—এ কবুতর ছিল, তাও উড়িয়ে দিল। শেষে বসুমতীকে প্রণাম করল দুহাত ঠেকিয়ে।
এমন অবস্থায় গোমানির রাগ না বেড়ে যায় না। নেলি কথা বলছে না, খেতে দেবে কী দেবে না—তাও কিছু বলছে না। বড় বাড় বাড়ছে মেয়েটা। সে ডাকল, হে শুয়োরের ছা, তুকে কী বলিছে হাম? যেছিস কুথা।
যেছি—মরতে। নেলি সাফ জবাব দিল। সাফ সাফ কথা বলল। সে ফের মাচানে উঠে গেল এবং একটা কাঁথা শরীরে জড়িয়ে নিল। রোদের তাপ বাড়ছে একটু একটু করে। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে সে তা ধরতে পারছে। কবুতরগুলো উড়ে উড়ে চালে, মাঠে ময়দানের ঝাউগাছটায় বসল। সে দেখল কবুতরগুলো পরস্পর ঠোঁট কামড়াচ্ছে—। ঝাউগাছের ডাল ধরে রোদ নিচে নামছে—সে দেখল। একটা পোয়াতি মাদি শুয়োর কাঠগোলায় শুয়ে আছে—সে দেখল। সে এখন ওর গঙ্গা যমুনাকে খুঁজছে! এই ভোরে ওরা কোথায় গেল! সে গলা ছেড়ে ডাকল, গ….ঙ্গা….যমু…..না, কুথা গেলি এবেনে তুরা।
গোমানি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল মাচানে। বুকটা ওর ভেঙে যাচ্ছে উঠতে। নেলির ভাবসাবগুলো ওকে উন্মাদ করে দেবার মতো। সে কাশতে কাশতে বলল, দেখ নেলি, তুর এ ভাবসাব হামার ভালো লাগে না। যা বুলবি সাফ সাফ বুলবি—লয়তো ঘাটের মড়া মুখে ঠেসে ধরবে।
নেলি তখন ওর কুকুর দুটোকে আদর করছিল। ওরা ওর গায়ের ওপর লাফিয়ে উঠছে। সে শুনতে পাচ্ছে—বাপের গলায় গরল। সেও গরল তুলল গলায়—কিয়া বাত তুম বলেহ! ঘাটের মড়া ঠেসে ধরবে! ধর, ধরে যদি খানা মিলেত জরুর ধরবে।
হরীতকী শরীর পরিষ্কার করে ফেল দরজায় বসে সব দেখছে। শ্মশানে বিয়ানো বাচ্চাটা কাঁদছে ওর কোলে। সে এই সব দেখতে দেখতে ষাট সোহাগ করল, নেলি ওর ঘরের দিকেই আসছে। কুকুর দুটো তখন উঠোনের মাটি শুঁকছে। হরীতকী বাচ্চাটাকে রোদে রেখে দিল। তখন ঝাড়ো ডোমের ঘরে কী নিয়ে বচসা হচ্ছে। শিবমন্দিরের পথ ধরে শহর থেকে যাত্রী নামছে তখন। ওদের কোলাহল এই চটানে ভেসে আসছে। নেলি সেই সব কোলাহল শুনতে শুনতে হরীতকীর দরজায় এসে হাজির হল। পিসির বেটি রয়েছে—বেটির পাশে বসল। নাক নেড়ে আদর করল।
হরীতকী বলল, কিরে ভোর না হতেই বাপের সাথ ঝগড়া বাঁধালি?
হেঁ বাঁধিয়েছি ত। নেলি জবাব দিতে গিয়ে ঘাড়টা কাত করে দিল। হরীতকী ধমক দিল নেলিকে। ওকে শাসন করারও ইচ্ছা। —যা যা ঘরে যা। বাপকে দুটো রেঁধে দেগা। হাসপাতাল থেকে পুলিশ এলে ওকে ফের ভুখা যেতে হবে।
নেলি চুপচাপ ঘাড় গুঁজে পিসির বেটির পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর কী ভেবে পিসিকে জবাব দিতে গিয়ে ভেঙে পড়ল—তু বল পিসি, হামি ওয়াকে কী রেঁধে দি। ঘরে কিছু না আছে। গিল রাতে ভুখা থাকতে হল। বুললাম তু যা, এক আধ রুপেয়া ধার লিয়ে চাল দাল কিছু লিয়ে আয়। গিল ঠিক, টাকায় আট আনা সুদে ধার ভি লিল, কিন্তুক কিছু চাল দাল লিল না। পারে সব কুচ রেখে দিল। পিসি, হামি ওয়াকে কী রেঁধে দি বুল।
এই সব কথা শুনে হরীতকী নেলিকে এড়িয়ে যেতে চাইল। এই সাত সকালে গোমানি ডোমের জন্য দরদ উত্থলে ওঠায় নিজের উপরই সে বিরক্ত হল। সেজন্য হরীতকী কোনো জবাব দিল না। পিসির বেটির পাশে বসে মাটিতে নেলি আঁচড় কাটছে। ঘাটের কাঠ এসেছে গরুর গাড়িতে। দূরে কুকুরের আওয়াজ, মোরগ, শুয়োর, কবুতরের শব্দ নেলির দেহমনকে কেমন মাতাল করে রেখেছে যেন। সে নড়তে পারছে না পর্যন্ত। গোমানি কাশছে! বসে বসে নেলি গোমানির গালাগাল খাচ্ছে। সে তখন মাতালের মতো উঠে দাঁড়াল। কুকুর দুটোকে নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেল। কিন্তু ভুখা শরীর নিয়ে ওর চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
শীতের গঙ্গা। জল নেই—হুহু করে বাতাস আসছে উত্তর থেকে। নেলির একমাথা চুলের খোঁপা খসে গেছে। ওর পাঁশুটে চুল বাতাসে উড়ছে। ঘাটে মড়া আসেনি। শ্মশানটা সেজন্য খাঁ খাঁ করছে। শ্মশানের চালাঘর ফাঁকা। কুকুরগুলো সেখানে জটলা পাকাচ্ছে। নেলির উপোসী শরীরটা চলছে না। ও ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। যাত্রীদের ঘাট থেকে সে একটু দূরে দাঁড়াল। কুকুর দুটো ওর দুপাশে। কুকুর দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখল, উত্তরের হাওয়া গায়ে মাখাল এবং হিসেব রাখল যাত্রীরা কটা তামার পয়সা জলে ফেলছে।
চটান থেকে নামছে গেরু, সোনাচাঁদের ছেলে টুনুয়া, ঝাড়ো ডোমের বেটা লখি। গেরু নেলির পাশে এসে দাঁড়াল। নেলির গঙ্গা যমুনাকে আদর করল। ওরা যাত্রীদের অপেক্ষায় আছে। যাত্রীরা উঠবে ওরা নামবে। যাত্রীদের পয়সা, সোনাদানা, ডুবে ডুবে তুলবে।
গেরু বলল, নেলি তু এত সকাল সকাল!
তুভি ত এসেছিস রে। সকাল সকাল হামি একলা না আছি।
লেকিন তুর বাপ চিল্লাতে শুরু করেছে। বুলছে ও মাগি কাঁহা গ্যাল!
বুলছে ত বুলছে। লেকিন তুর নসিব ত ভাঙেনি।
লখি, টুনুয়া ততক্ষণ সবুর করতে পারল না। ওরা সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সন্তর্পণে নেমে পড়েছে। যাত্রীদের চোখেও ওরা ধরা পড়ছে না। টুনুয়া একটা ডুব দিল। টুনুয়া, লখি একসঙ্গে ডুব দিল। ওরা ডুব দিয়ে যাত্রীদের ভিতরেই ভেসে উঠছে। ওরাও যাত্রী হয়ে গেছে। নেলি গেরু এই সব দেখতে পেয়ে লাফিয়ে জলে পড়ল। শীতের জলে ডুব দিয়ে যাত্রীদের ভিতর হারিয়ে গেল।