সুবল উঠে দাঁড়াল এবং ওর মাথায় লম্বা টিকি দেখে মেয়েটি প্রথমে চিৎকার থামিয়ে দিল। সুবলের বড় বড় চুল, প্রায় চুলে মুখ ঢেকে যাচ্ছে, সুবলের শরীরে ঘাম এবং ময়লায় অথবা বলা যেতে পারে অপরিচ্ছন্নতার গন্ধ। সুবলকে দেখে মেয়েটি এবার ভয়ে যেন গুটিয়ে যাচ্ছে ফের। সে সন্তর্পণে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
সুবল বলল, মা, আমার একটু জল আছে। জলটা ওকে দিতে পারি মা। ওর খুব তেষ্টা পেয়েছে।
মা বললেন, তুমি জল দেবে কী বাছা! জল তোমার কোথায়?
সুবল বলল, এই যে! সে একটা বাঁশের চোঙ বের করে দেখাল।
—এই চোঙায় জল আছে মা। আমার একটি পাখি আছে মা! পাখির জন্য একটু জল নিয়েছি মা।
মা বললেন, না বাছা। জল তোমার বড় নোংরা।
সুবল কোনও কথা বলল না। সে তার পাখিটাকে পাশের পকেট থেকে তুলে এনে হাতের কবজিতে বসাল। নীচে ছোট ছোট পুঁটলি সুবলের। সংসার বলতে যা—কিছু সবই শেষদিকে সুবলের সঙ্গে সঙ্গে থাকত। কারণ ওদের কোনও ঠিক ছিল না কখন কোথায় ওরা থাকবে। বৃদ্ধ পুরোহিত মানুষটি তাদের সকলকে নিয়ে স্থানে স্থানে জলের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। বৃদ্ধের কথা মনে হতেই অন্য একটা চোঙে পাখিটাকে পুরে রাখল। পোকামাকড় যা—কিছু পাখিটার জন্য, পোঁটলা খুলে দেখল। পোঁটলা খুলতেই ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সেটা হাত থেকে খসে পড়ল, আর পোকামাকড়গুলো পর পর ছড়িয়ে পড়ল। বৃদ্ধের কথা মনে পড়েছে, কামরায় কামরায় খুঁজে দেখলে হয়, কোনও কামরায় তিনি হয়তো আছেন। কারণ সুবল ভেবেছে ভিড়ের সঙ্গে তিনি নিশ্চয় উঠে এসেছেন। কিন্তু পোকামাকড়গুলো ছড়াতেই যাত্রী তিনজন, বিশেষ করে রুগণ মেয়েটি হইচই বাধিয়ে দিল ভয়ে।
পোকামাকড়গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। আলোর ভিতর ওরা চোখে দেখতে পাচ্ছে না—বালিকার অথবা প্রৌঢ় ব্যক্তিটির পিঠে শরীরে মুখে বেয়ে বেয়ে উঠে যাচ্ছে। সুবল ভয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমনটা হবে জানা ছিল না। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে হাত থেকে পোঁটলা খসে পড়বে এবং ঘরময় কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে ভাবতে পারেনি সুবল।
ট্রেন বেগে চলছে, মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইসল কানে বড় বেশি বাজছে! পাখিটা সুবলের মাথায় হাতে এবং ঘাড়ে উড়ে উড়ে বসছে। পাখিটাকে দেখে মেয়েটি ওর সব দুঃখ যেন ভুলে যাচ্ছে। এমনকি এই যে কীটপতঙ্গ মেঝের ওপর, দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। কী সুন্দর পাখি, সোনার রঙের ঠোঁট, পায়ে সবুজ ঘাসের রঙ, পাখা কালো, গলার নীচে লাল রিবন যেন বাঁধা, নরম এবং কোমল পাখি। সুবলকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে পাখিটা, পাখিটার বয়স আর কত, পাখিটা উড়ে উড়ে দেয়ালের দিকে চলে যেতে থাকল এবং একটা একটা করে কীটপতঙ্গ ধরে এনে সুবলের জেবে ভরে দিতে থাকল।
সুবল দেখল, তার পোষা পাখিটা বড় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে। সে যেন ইচ্ছা করলে এই পাখি নিয়ে সকলকে এখন খেলা দেখাতে পারে।
সুতরাং এখন কামরায় চারজন। বিশেষ করে মা—বাবা এই পাখিয়ালা সুবলকে আর ঘৃণার চোখে দেখতে পারছে না। মেয়েটা এই যে এতক্ষণ কেবল ছটফট করছিল—আমার কিছু ভালো লাগছে না মা, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও চলে যাব মা, মা আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? এইসব দুঃখকর কথা আর বলছে না। একটা পাখি, সাধারণ পাখি আর এক পাখিয়ালা, কোথাকার এক পাখিয়ালা, ময়লা, বিশীর্ণ চেহারা, দেহাতি—কোনো আশা—আকাঙ্ক্ষা নেই, শুধু যেন এই পাখি বেঁচে থাক, পাখি থাকলেই সব থাকল, পাখির খেলা দেখিয়ে সে সকলকে বুঝি মুগ্ধ করতে চায়।
টুকুন বলল, এই পাখিয়ালা।
সুবল চোখ তুলে তাকাল।
—পাখিয়ালা, দ্যাখো এখানে একটা লম্বা গঙ্গাফড়িং।
পাখি কী দেখল, সুবল পাখিকে কী বলল বোঝা গেল না। পাখি উড়ে গিয়ে ফড়িংটাকে ঠোঁটে ঠেসে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে টুকুন অতীব আনন্দে হাততালি দিতে থাকল। আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চোখে জল এসে গেল। যেন বলতে চাইল—পাখিয়ালা, তুমি জাদুকর, জাদু তোমার হাতের খেলনা। এই মেয়ে কতকাল তার হাসি ভুলে ছিল, কতকাল এই মেয়ে আমার হাততালি দেয় না, আনন্দ করে না। পাখিয়ালা, তুমি আমার এই মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছ, তুমি বুঝি জাদুকর!
এই করে এখন আর কোনও বেদনার চিহ্ন আঁকা নেই। কোনও জলতেষ্টা নেই।
টুকুন বলল, পাখিয়ালা, তুমি এই পাখি কোথায় পেলে?
—গাছের নীচে দিদিমণি।
—কী গাছ ছিল ওটা?
—একটা শিরিষ গাছ ছিল।
—পাখিটার বুঝি কেউ ছিল না?
—কেউ ছিল না। ওর মা—বাবা ওকে ফেলে রেখে চলে গেছে। কী খরা আমাদের দেশে! কী রোদ ছিল, কী দুঃখ। আমাদের লোকগুলো টুকুনদিদিমণি, তোমাকে কী বলব, আমাদের লোকগুলো সতেরো আঠারো দিন জল খেতে পায়নি।
বাবা বললেন, সুবল, তোমাদের কোনও সরকারি সাহায্য মেলেনি?
সুবল কী বলবে ভেবে পেল না, কিছুদিন কিছু লোক বড় বড় গাড়ি করে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে ফিরে গেছে, বড় বড় পরিকল্পনার কথা বলে গেছেন। ঐসব পরিকল্পনার কথা সুবল বোঝে না। বড় বড় নেতাগোছের মানুষ এসেছিল। দেশের জননী এসেছিলেন। তিনি খিচুড়ি মুখে দিয়ে কেমন খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে সকলকে, তার স্বাদ চেখে গেছে। কিন্তু মানুষের তেষ্টা দেখে যাননি।
হায়, সুবল যেন বলতে পারত, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো আর। গোরু—ভেড়া নিয়ে মানুষেরা চলে যাচ্ছে, মাটি ফেটে গেছে, শুকনো উত্তাপ, লু বইছে এবং গাছে মৃত ডাল শুধু, মাঝে মাঝে কোনও পাহাড়ের গায়ে দাবানল জ্বলতে দেখা গেছে। এক বুড়ো ঠাকুর সেই দাবানল দেখে বলেছে, দেশের পাপ, এত পাপ আর ধরণী সহ্য করবে না। পাপে দেশ ছেয়ে গেছে, অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মরুভূমির মতো হাহাকার করছে গোটা দেশ। বুড়ো ঠাকুর এই বলতে বলতে একটা গাছের ডালে নিজের বস্ত্র বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল।