এবং এভাবে এক শাহেন—সাহ মানুষ, সব অহঙ্কার মুছে আজ এখানে চলে এসেছেন। সুবলের ভারী ভালো লাগছে। তিনি বললেন, তোমার বুড়ো মানুষটা কোথায় থাকত?
—এ ঘরেই।
—তোমাকে খুব ভালোবাসতেন তিনি?
টুকুন বলল, বাবাকে দেখাবে না! অর্থাৎ টুকুন বাবাকে সেই বুড়ো মানুষটার সমাধি দেখাতে চায়। কতদিন টুকুন পালিয়ে এসে সবুজ ঘাসে কাঞ্চনের ছায়ায় চুপচাপ বসে রয়েছে। কতদিন পালিয়ে এসে বেশ রাত করে ফিরেছে। টুকুনের মা শেষ দিকে নানাদিক ভেবে ওর বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরিবারের মান—সম্মানের কথা ভেবে, তা ছাড়া টুকুনের এটা পাগলামি ছাড়া কী, কোথাকার এক ফুলয়ালা, যার চাল নেই, চুলো নেই, শহরে এখন ফুল বিক্রি করে খায়, তেমন এক মানুষের সঙ্গে টুকুনের এসব ঘটনা বড় পীড়াদায়ক। তিনি টুকুনকে আর বের হতে দিতেন না।
আর বিকেলে কী মনে হয়েছিল টুকুনের বাবার, হঠাৎ এসব হতেই বুঝি ভিতরে একটা গোলমাল দেখা দেয়। যা এতদিন সত্য জেনেছেন, সব মনে হয় অহমিকার কথা। সেই ফুলওয়ালার কাছে যেতে মনে হয়, টুকুন নিশিদিন যায়, গল্প করতে ভালোবাসে। —বাবা, সুবল তো তোমার মতো ভাবে না, সে তো তোমার যম দুঃখ পায় না। এখানে তো মানুষেরা মানুষের মতো কাজ করছে। নদী থেকে জল আনছে। লতাপাতা থেকে সার বানাচ্ছে। চারপাশে নানারকম পাম্প সেট, যখন যেখানে জল দরকার চলে যাচ্ছে। কারও নালিশ নেই, কারও তেমন ব্যক্তিগত উচ্চাশা নেই, বেশ তো ওরা। সারা উপত্যকাময় কীসব সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে।
এবং এভাবেই তিনি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন এখানে। স্ত্রী জানেন না। মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। যেন দেখতে চান, যথার্থই পৃথিবীতে কোনও ফুলের উপত্যকা গড়ে উঠতে পারে কী না। তিনি বললেন, চলো, কাঞ্চন গাছগুলোর নীচে গিয়ে বসি।
সুবল বুঝতে পারল, তিনি সেই বুড়ো মানুষটার সমাধির পাশে বসে থাকতে চান। সুবল যেতে যেতে বলল, বুড়ো মানুষটার একমাত্র অহঙ্কার ছিল, কেউ ওর মতো ফুলের চাষ জানে না। ফুলের দালাল ঠকিয়ে ফুল নিয়ে যেত, কিছু মনে করতেন না। কেবল বললেই হত, মিঞাসাব আপনার ফুলের মতো ফুল আর কার আছে। তিনি তার পরিশ্রমের পয়সা পেতেন না। একটু থেমে বলল, ফুলের দালালি করতে এসে এখানে থেকে গেলাম। কেমন বুড়োমানুষটার জন্য মায়া হল। এর কাজ করতে কষ্ট হলে কাজ করে দিতাম। বন থেকে পাতা এনে দিতাম। পাতা পুড়িয়ে তিনি জমির সার বানাতেন! তাঁর কাছে আশ্চর্য সব খবর জেনে নিলাম। তার ফুলের চাষ এত কেন ভালো, বনের কোন গাছ, কী পাতা কোন সময়ে পোড়ালে কোন ফুলের উপকারে আসে, পৃথিবীতে কেউ বোধ হয় ওঁর চেয়ে তা ভালো জানতেন না। তখন বুড়ো মানুষটার আমি বাদে আর কেউ ছিল না।
বাবা বললেন, সুবল তোমার অহঙ্কার হয় না? শহর থেকে কত মানুষজন এই ফুলের উপত্যকা দেখতে আসছে—এতবড় এক ফুলের উপত্যকা তুমি গড়ে তুলেছ এখানে। সব মানুষের জন্য রেখেছ সমান দায়িত্ব, বড় শহরে সকালে যায় সারি সারি ফুলের গাড়ি, তোমার মনে হয় না রাজার মতো বেঁচে আছ?
সে বলল, আজ্ঞে না। আমার তখন বুড়ো মানুষটার কথা মনে হয়।
—কী বলেন তিনি?
ওরা সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে বসে রয়েছে। টুকুন এখন নানা বর্ণের ফুলের ভিতর ঘুরে ফিরে কেমন মজা পেয়ে গেছে, সামান্য জ্যোৎস্নায় ছুটতে পর্যন্ত ইচ্ছা করছে। তখন সুবল বলছে বুড়োমানুষটার কথা। সে বলল, তিনি বলতেন, আল্লা খুব সরল। তিনি চান পৃথিবীতে সরল এবং ভালোমানুষরা সুখে থাকুক। তারপরই সুবল কেমন চুপ হয়ে যায়। একটু পরে থেমে থেমে সুবল বলল, তিনি বলতেন, সব লতাপাতার ভিতর, ফুলফলের ভিতর এবং সব গ্রহ—নক্ষত্র, অথবা এই যে সৌরলোক, যা কিছু আছে চারপাশে, সবার ভিতর তিনি আছেন। কোনো উপাস্য নেই তিনি ভিন্ন। তিনি রাজার রাজা। তিনি সবচেয়ে প্রাজ্ঞ। যা কিছু আছে আকাশে আর যা আছে পৃথিবীতে—সব তাঁর। তিনি জানেন সবকিছু। সৃষ্টি—স্থিতি—প্রলয় তাঁর অন্তর্লোকের রহস্য। তিনি জানেন একমাত্র কী আছে সামনে আর কী আছে পেছনে। তাঁর আসন আকাশ আর পৃথিবীর ওপরে বিস্তৃত। আর এ—দুয়ের তিনি নিশিদিন রক্ষাকারী। তার জন্য তিনি ক্লান্ত বোধ করেন না।
সুবল কী দেখল এবার। সে দেখল টুকুন ঘাসের ভিতর কাঞ্চন ফুলের পাঁপড়ি সংগ্রহ করছে। কী সুন্দরভাবে উবু হয়ে বসেছে। কী মায়ায় ভরা মুখ! সে কিছুতেই বেশি আশা করতে পারে না। সে বলল বুড়োমানুষটার কথা মনে হলে নিজেকে কিছুই ভাবতে ভালো লাগে না। এমন কথা শুনলে আপনার বিশ্বাস হবে কিনা জানি না।
টুকুনের ভারী আশ্চর্য লাগে সেই সুবল, ফুটপাতে সে ঘুরে বেড়াত, যার কোনও ঠিকানা ছিল না, নিজের বলতে কিছু ছিল না, কী করে সেই মানুষ এমন সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা যা মাইলব্যাপী কী তারও বেশি হবে কতদূর গেছে সে ঠিক জানে না, কীভাবে গড়ে তুলেছে!
সুবল ফের বলল, তিনি প্রায়ই মুসার কথা বলতেন। বলতেন বারোটি প্রস্রবণের কথা। লোকদের জন্য তিনি জল চাইলেন। মরুভূমিতে কোথায় জল! অথচ দৈববাণী, মুসা তার লাঠি দিয়ে বারোটা পাথরে বাড়ি মারলেন। জল উপছে ঠান্ডা জলের প্রস্রবণ। মুসা বললেন, জল পান করো মনুষ্যগণ। আল্লাহ যে জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে খাও আর পান করো। অন্যায়কারী হয়ে দেশে অপবিত্র আচরণ কোরো না।