টুকুনের বাবা বললেন, এসে খুব ভালো লাগছে। এমন একটা ফুলের উপত্যকা কোথাও থাকতে পারে জানা ছিল না। আমি তো বেশ হেঁটে যাচ্ছি, হাত তুলে তিনি বললেন, ডাক্তারদের কথা আর শুনছি না। বেশ আছি হে। তা তুমি কেমন লাভ টাব কর!
—লাভ!
—এই ফুল বেচে। টুকুন বলল, তোমার নাকি লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয় মাসে! তারও বেশি। এত টাকার ফুল বিক্রি করে খুব লাভ হওয়ার কথা।
—লাভ টাব বলে তো কিছু নেই।
—তবে কী আছে?
—যা আছে তাকে আরও বাড়ানো।
—সেটা কার জন্য?
—যারা কাজ করে, যারা এখানে থাকে খায়…..
—তবে তুমি কে?
—আমিও কাজ করি।
—কিন্তু বুড়ো মানুষটা তোমাকে দানপত্র করেছে না?
—তা করেছে।
—তবে তুমি মালিক। তোমার এখানে লেবার আনরেস্ট নেই শুনেছি!
সুবল বুঝতে পারল বিষয়ী মানুষ, তিনি বিষয়—আশয় ছাড়া বোঝেন না। সে তাঁকে বলল, বসুন।
তিনি এমন বড় উপত্যকার বিচিত্র বর্ণের সব ফুল এবং মানুষেরা এখনও কেউ কেউ কাজ করছে দেখে কেমন অবাক। —এরা বুঝি ওভার—টাইম খাটছে।
সুবল বলল, না। কাজ বোধ হয় শেষ করে উঠতে পারেনি।
—তোমার ফুলের গাড়ি কখন যায়?
—ভোর রাতে।
—কতজন লোক এখানে কাজ করে?
—তা অনেক হবে। তার হিসাবটা……
—তুমি কী হে। কোনো হিসেবপত্র রাখো না।
—না, মানে কী জানেন সবাই কাজ করে না তো। সবাই….।
—ওরা কোথায় থাকে?
তিনি আবার বললেন, এ—পাশের ছোট্ট একটা ছিমছাম শহরের মতো চোখে পড়ল। ওখানে কারা থাকে?
—এরা থাকে।
—এসব তুমি ওদের করে দিয়েছে।
—আমি করিনি। ওরা নিজেরাই করে নিয়েছে।
—তা হলে তোমার এখানে সত্যি গোলমাল হয় না।
সুবল হেসে বলল, কীসের গোলমাল?
—এই বোনাস নিয়ে, ইনক্রিমেন্ট নিয়ে।
সুবল ভেবে অবাক হয়ে যায়, এসব কথা সে শোনেনি। যখন সবই ওদের, ওরা যৌথভাবে খেটে এমন একটা উপত্যকা বানিয়ে ফেলেছে, কেন যে ওরা গোলমাল করবে, বুঝতে পারে না।
টুকুনের বাবা বললেন, সুবল তোমাকে আর চেনা যায় না। টুকুন তোর মনে আছে আমরা ট্রেনে আসছিলাম, তখন বিহার পূর্ণিয়া অঞ্চলে কী খরা। নীল রঙের বেতের চেয়ারে বসে তিনি কথা বলছিলেন। একটা নীল রঙের লণ্ঠন কেউ জ্বেলে দিয়ে গেছে। তিনি ফের বললেন তোমার পাখিটার কথা খুব মনে হয়।
সে অনেকদিন আগের কথা। ওরা তিনজনই মনে করতে পারে—কোথায় কবে এক প্রচণ্ড খরায় সব জ্বলে যাচ্ছিল, একদল তৃষ্ণার্ত লোক ট্রেন আটকে জল লুট করেছিল, এবং সুবল সেও এসেছিল জল খেতে। জল খেতে এসে অবাক, এক মেয়ে কী সুন্দর, মোমের পুতুলের মতো বাংকে শুয়ে আছে, উঠতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কেবল চেয়ে থাকে, আর কী সুন্দর মুখ তার, দেখতে দেখতে সুবল অবাক হয়ে যায়। জল পান করতে হবে, অথবা সে তার তেষ্টার কথা ভুলে, কেমন ভেবে পায় না, কোথাও এমন সুন্দর মোমের মতো নরম চোখ অথবা কুঁচফলের মতো নাক থাকতে পারে। সে মেয়েটিকে তার জেবের পাখির খেলা দেখিয়েছিল। সুবল, এক আশ্চর্য বালক, জাদুকরের শামিল তখন। টুকুনের বাবা দেখেছিলেন, টুকুন সুবলকে বাংকের নীচে লুকিয়ে রেখেছে, পুলিশ এলে বলছে না নেই, এ—কামরায় কেউ আসেননি। যে মেয়ের মরে যাবার কথা যার কঠিন অসুখ যে ক্রমে স্থবির হয়ে যাচ্ছে তার এমন স্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে তিনি চোখ বড় করে ফেলেছিলেন। অথচ টুকুনের মা—র কী যে স্বভাব, কোথাকার এক নচ্ছার ছেলে উঠে এসেছে, তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি, চাল নেই, চুলো নেই, হয়তো মন্ত্র—টন্ত্রও জানে, মেয়েটাকে বশ করার তালে আছে, প্রায় জোরজার করে ব্যান্ডেলে গাড়ি এলে তিনি সুবলকে নামিয়ে দিয়েছিলেন।
অথচ সুবল মনে করতে পারে, এক হাসপাতালে আবার দেখা টুকুনের সঙ্গে। সে তার পাখিটাকে নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে ডাব কেটে বিক্রি করত। সে ভেবেছিল, তখন শহরে এটাই সবচেয়ে ভালো কাজ। সে প্রায় নিজের মতো করে একটা জলছত্রও দিয়েছিল। আরও অনেক কাজ, এবং কাজের ভিতরই সে ফের হাসপাতালের জানালায় আবিষ্কার করেছিল টুকুনদিদিমণিকে। সে তখন প্রাণপণ, সেই জানালায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নানারকম আশ্চর্য গল্প, রূপকথার গল্প, জাদুকরের দেশে মুণ্ডমালার গল্প বলে টুকুনদিদিমণিকে সাহস দিত। বেঁচে থাকতে বলত। কারণ সে বিশ্বাস করতে পারত না, পৃথিবীতে সুন্দর মেয়েরা কখনও মরে যায়।
সুবলের এমন প্রাণপণ খেলা দেখে টুকুনেরও ভারী ছুটতে ইচ্ছা হত। টুকুন এই যে এখন বসে আছে, সুবল বসে রয়েছে সামনে, বাবা পাশে, বাবা সন্দেশ দুধ খাচ্ছেন, সুবল চা খাচ্ছে, সে চা ডিম ভাজা খাচ্ছে, এরই ভিতর যেন এক আশ্চর্য সৌরভ সে পায় সুবলের শরীরে, সুবলের কথা মনে হলেই সেই সব পুরনো দিনের কথা মনে হয়—এবং সুবলই পৃথিবীতে একমাত্র বাওবাব গাছ খুঁজে আনতে পারে—তার বিশ্বাস হয়। সে ভাবতে থাকে, সুবল না থাকলে, সে বুঝতে পারত না, ছোট্ট রাজপুত্রের কোনও গ্রহাণু থাকতে পারে, আর সেখানে আগ্নেয়গিরির মুখ ঢেকে রাখার জন্য বাওবাব গাছের পাতা লাগে।
তারপর আরও কীসব দিন গেছে টুকুনের। সুবল একবার এল ফুল নিয়ে। সব দামি গোলাপ, তখন সুবলকে চেনা যেত না। সে পালিয়ে আসত, আর কী রোমাঞ্চ, সে এলেই মনে হত শরীরের যাবতীয় অসুখ কেমন সেরে গেছে! টুকুন তখন নাচতে পারত, সে জোরে পিয়ানোতে নানা বর্ণের স্বর তুলতে পারত। যেন কবিতার মতো এক ঘ্রাণ আছে সুবলের চোখে মুখে, সুবল এলেই শরীরের সব কষ্ট এক মায়াবী সৌরভে মুছে যেত। ঘরের সাদা অথবা হলুদ রঙের দেয়ালে টুকুন মাঝে মাঝে তখন বনের দেবী হয়ে যেত।