সুবল লোকজনের বিদায় করে নিজের আশ্রমের মতো ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। সে দেখতে পায় পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। গাছের ছায়া লম্বা হয়ে যাচ্ছে, নদীর জলে অন্ধকার নেমে আসছে। এ সময় মনে হয় কেউ আসবে, ঠিক পালিয়ে চলে আসবে, সে তাকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারে না। এমন একটা আশ্চর্য ফুলের উপত্যকা আর কোথাও নেই সে জানে। আর তখনই মনে হয় দূরে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠেছে টুকুনদিদিমণি। এমন ফুলের উপত্যকা পেয়ে টুকুনদিদিমণি প্রায় যেন ভেসে ভেসে চলে আসছে। সে চোখ মুছে ফের উঠে দাঁড়াল। না, সে অলীক কিছু দেখছে না, ওর ভিতরটা কী যে করছে! টুকুন, হালকা বাদামি রঙের প্রায় ফুলের গাছগুলো মাড়িয়ে ছুটে আসছে। সঙ্গে কেউ আছে, বয়সি মানুষ, তিনিও যুবকের মতো হেঁটে আসছেন। সুবল বুঝতে পারছে না, টুকুনের সঙ্গে কে আসছে! তার বারান্দা ফুলের ডালপালায় ঢাকা। ওর ভিতর থেকেই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, টুকুনদিদিমণি, আমি এখানে।
এখন হেমন্তের সময়। হেমন্তে ফুলের চাষ তেমন জমে না। মানুষজন যারা আছে, খেটে খেটে হয়রান, পাম্পে জল তুলে আনছে, নদী থেকে জল এনে অসময়ে সে যা চাষাবাদ করছে ফুলের, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। দূরে দূরে সব সাদা কোঠাবাড়ি, ছবির মতো উজ্জ্বল এক ছোট্ট ছিমছাম শহর যেন। পাকা রাস্তা চলে গেছে উপত্যকার ভিতর দিয়ে। নানা জায়গায় সব জলের ফোয়ারা এবং অসময়ে সব ফুলেরা ফুটে আছে। শীতে সে মাইলের পর মাইল গোলাপের চাষ করে থাকে, কে কত বড় গোলাপ ফোটাতে পারে—সুবলের কাছে কে কত বড় মানুষ তার দ্বারা প্রমাণ হবে। আমি এক মানুষ, আমার আছে এক বড় অহঙ্কার, ফুলের মতো ফুল দ্যাখো কী করে চাষাবাদ করে গড়ে তুলেছি। সুবলের মনে হল তখন, টুকুনের কেউ এসেছে সঙ্গে। ওরা, চাঁপা ফুলের যেসব সারি সারি গাছ আছে তার নীচে দিয়ে হাঁটছে। মেহেদি পাতার গাছ চারপাশে সবুজ হয়ে থাকে বলে কীযে সুন্দর লাগে সুবল যখন হেঁটে যায়। লম্বা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, ঢোলা সাদা রঙের পাজামা আর ঘাসের চটি, সুবলকে তখন কেমন বনের দেবতা টেবতা মনে হয়!
সুবল কাঞ্চন গাছের নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দুটো একটা কাঞ্চন ফুল এখনও ফুটছে। সাদা পাঁপড়ি বুড়োমানুষটার সমাধিতে পড়ছে। আর চারপাশে কী সবুজ ঘাস, ঘাসে এখন সব সাদা ফুল, সব ফুলগুলোই যেন বলছে, আমরা বুড়োমানুষটার হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকব। ফুলগুলো দেখলে সুবলের এমনই মনে হয়। সে আর সেখান থেকে বেরতে পারে না।
সুবল কাঞ্চনের ডাল মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলতেই দেখল, ও আর কেউ নয়, টুকুনের বাবা। সে প্রথমেই অবাক, তারপর কেমন অস্বস্তি, তারপর মনে হল বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যাওয়ার শামিল, বোধ হয় এক্ষুনি তিনি তাকে তাড়া করবেন, অথবা যেমন তিনি মানুষের সূর্য বগলদাবা করে পালাচ্ছিলেন, এখানে তিনি তেমন কিছু করে ফেলবেন। দূরে নদীর পাড়ে তার দামি গাড়িটা। ডিমের মতো ঘাসের ওপর ভেসে আছে গাড়িটা। সূর্যাস্ত, বনের ছায়া, নদীর জল, সব মিলে সাদা রঙের গাড়িটাকে অতিকায় রাজহাঁসের ডিম ছাড়া ভাবতে পারছে না সুবল। টুকুনের বাবাকে দেখে সে সত্যি ঘাবড়ে গেছে। সে আর পালাতে পর্যন্ত পারল না। ফুলের উপত্যকায় সে একজন বনবাসী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।
অথচ তিনি কাছে এসে বললেন, বাওবাব গাছ এনেছি হে।
সুবল ভেবে পেল না এমন কথা কেন! বলল, বাওবাব গাছ!
—কেন টুকুন যে বলল, তোমার এমন সুন্দর ফুলের উপত্যকাতে একটা বাওবাব গাছ না থাকলে মানাচ্ছে না।
সুবল কেমন সহজ হয়ে গেল। ওর আর টুকুনের বাবাকে ভয় থাকল না। সে ভেবেছিল, আবার কী ঘটেছে, টুকুনকে নিয়ে কী অশান্তি দেখা দিয়েছে সংসারে যে, টুকুনের বাবা এখানে পর্যন্ত ছুটে এসেছেন! সে তো আর যায় না। টুকুনের মা ওর যাওয়া পছন্দ করেন না, এ—নিয়ে বড় অশান্তি গেছে, সে টুকুনকে যেহেতু টুকুনদিদিমণি ডাকে, সেজন্য তার কোনও অশান্তি ভালো লাগে না। সে দেখল তখন টুকুনও কেমন সহজ হয়ে গেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে বলছে, তুমি আমাকে বলতে না, একটা বাওবাব গাছ পেলে এই উপত্যকাতে লাগিয়ে দিতে।
—কিন্তু সে তো রূপকথার গাছ। ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে পাওয়া যায়।
টুকুনের বাবা বললেন, ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে যা পাওয়া যায়, এখানে তা থাকবে না সে কী করে হয়?
সুবল বলল, আজ্ঞে তা ঠিক। আমার খুব ইচ্ছা—পেলে লাগাই। তবে রূপকথার গাছ তো, পাওয়া যায় না। যা কিছু ভালো, এই ফুলগাছ, লতাপাতা সব এনে লাগাতে ইচ্ছা হয়। তবে গল্পের গাছ তো পাওয়া যায় না। টুকুনদিদিমণি জানে সব। ওটা একটা অন্য গ্রহের গল্প।
—এসো। বলে তিনি সুবলের আশ্রমের মতো ঘরটার দিকে হাঁটতে থাকলেন। হাঁটতে হাঁটতেই বললেন, সব গ্রহের গল্পই আমরা বানিয়েছি। ছোট্ট রাজপুত্রের গ্রহটাতে একজনের মতো থাকার জায়গা আছে।
—তা আছে।
—ওর একটা ভেড়ার বাচ্চা আছে।
—তাও আছে।
—ওর গ্রহের সমুদ্র শুকিয়ে যাবে ভয়ে পাতায় ঢেকে রাখে।
—তা রাখে। আসলে আমরা চাই যে গ্রহেই মানুষ থাকুক, ঈশ্বর তার থাকা খাওয়ার নিরাপত্তা রাখবেন। রাজপুত্রেরও তা ছিল।
সুবল ভেবে পাচ্ছে না এমন সুন্দর সুন্দর কথা টুকুনের বাবা কী করে বলছেন! সে তো জানে টুকুনের বাবার খুব অসুখ। স্ট্রাইক, লক—আউট, ক্লোজার নানারকমের হাঙ্গামায় মানুষটা হৃদরোগে ভুগছেন। অথচ এখানে একেবারে অন্য মানুষ। যদিও এই মানুষটা তার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেননি। টুকুনের জন্য ভীষণ মমতা তাঁর। টুকুন যা ভালোবাসে, তিনিও তা ভালোবাসেন। টুকুনের জন্য সুবল যখন ফুল নিয়ে যেত, দেয়াল টপকে, টুকুনের ঘরে পালিয়ে ফুল দিয়ে আসত, তখন সে জানত না ধরা পড়লে খুব সহজভাবে তিনি বলবেন, বড় বাড়িতে এভাবে আসতে নেই। সদর দিয়ে আসবে। টুকুনের তো সময় থাকে না। রোববারে আসবে। বিকেলে সে তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারবে। রোববারের বিকেলে টুকুনের কোনও কাজ থাকে না।