আর এভাবে এক মেয়ে—বোধ হয় এটা হেমন্তকাল—বেশ গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। সে দোকান থেকে ফুল আনার সময় সুবলের কিছু খোঁজখবর রেখেছে। কারণ শহরের সব ফুলের দোকানগুলো বলে দিতে পারে সুবলের কথা, সুবলের ফুল একদিন এই শহরে না এলে সব অন্ধকার দ্যাখে, সেই সুবলের খোঁজখবর সব তার কাছে থাকবে সে আর বেশি কী—এবং এভাবে সেও তার খোঁজখবর সুবলকে দিয়ে গেছে। সুবলের ওইটুকুই লাভ। সে টুকুনদিদিমণির চিঠি অতি যত্নে রেখে দিয়েছে। সে তার জন্য তপোবনের মতো আলাদা একটা আশ্রম করে দিয়েছে। বুড়ো মানুষটা মারা গেছে গত শীতে।
কাঞ্চন ফুলের চারপাশে সবুজ ঘাসের কাঠা চারেকের মাঠ। সেখানে ঘাসের ছায়ায় কাঞ্চন সৌরভে বুড়ো মানুষটা আছে। তার কবর শান বাঁধানো। কাঞ্চন ফুল দিন—রাত পাঁপড়ি ফেলছে সেখানে। বিকেলে যখন হাতে কোনও কাজ থাকে না, সুবল সেই ঘাসের ভিতর কাঞ্চন গাছটার নীচে চুপচাপ বসে থাকে। এসব খবর টুকুনদিদিমণিকে সে তার লোক মারফত জানিয়েছে। সে চিঠি লিখতে আজকাল পারে। কিন্তু হাতের লেখা এত খারাপ যে দিদিমণিকে চিঠি লিখতে লজ্জা পায়। টুকুনদিদিমণির সঙ্গে কতদিন দেখা নেই—বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না, সে যেন বুঝতে পারে টুকুনদিদিমণি বারান্দায় অথবা রেলিং—এ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারলেই ওর ভীষণ কষ্ট হয়—সব ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা হয়—কী এক আকর্ষণ শরীরে তার—কিন্তু টুকুনদিদিমণির অপমান ওর কাছে আরও কষ্টকর। এখন তো সে আর আগের মতো পাঁচিল টপকে যেতে পারে না। সে কেমন যেন ক্রমে স্বভাবে শহরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলো শহরে ফুল নিয়ে যাচ্ছে—তাদের টংলিং টংলিং শব্দ কানে এলে চোখ বুঝে পৃথিবীর যাবতীয় সুষমা সে শুষে নিতে পারে। এবং টুকুনদিদিমণির আশ্চর্য ভালোবাসা সে তখন ভিতরে ভিতরে বড় বেশি অনুভব করতে পারে।
মজুমদার সাব বললেন, তোর সুবল বাওবাব গাছ দিয়ে কী করবে রে টুকুন?
টুকুন এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পেল। বলল, বাওবাব গাছের কথা তুমি কী করে জানলে?
—সে জেনেছি।
—ওটাতো বাবা একটা গল্পের গাছ।
—মানে!
—মানে ছোট্ট রাজপুত্রের একটা দেশ আছে। সেটা একটা ছোটো গ্রহাণু। শিশুদের জন্য লেখা গল্প। সেখানে বাওবাব গাছের কথা আছে।
—তুই জানিস না, বাওবাব বলে সত্যিকারের গাছ আছে। জায়গায় জায়গায় নামটা পালটে যায়।
এখানে রাস্তাটা একটা বড় পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে বলে টুকুনকে খুব ধীরে ধীরে টার্ন নিতে হল। এখন হেমন্তকাল বলে বেশ শীত শীত ভাব। চারপাশে ধানের জমি। কাঁচা পাকা ধানের মাঠ। চাষিরা মাঠের আলে আলে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। কারণ বোঝাই যায়—ধান তোলার সময় হয়ে আসছে। খুব খুশি ওরা, ফসল ভালো, এবং এভাবে এই মাঠের সব জমি, চাষিদের মুখে আকাশের নীলিমা এবং কিছু পাখির কলরব টুকুনকে ভীষণভাবে আপ্লুত করছে। সে বাবার শেষ কথাটা ঠিক মন দিয়ে শুনতে পায়নি।
মজুমদার সাব ফের বলে যাচ্ছেন—আমি একটা বইয়ে পড়েছি, কেনিয়াতে কাণ্ডুরার জঙ্গলে এই গাছ আছে। ছবিতে যা দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে ঠিক আমাদের দেশে বাবলা গাছের মতো। আমার মনে হয় সুবল সেজন্য বাওবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে।
—আমি ঠিক জানি না বাবা। সুবলকে জিজ্ঞাসা করে দেখব।
—তোর মনে আছে যখন প্রথম সুবল গাড়িতে উঠে এসেছিল?
—মনে আছে বাবা।
—খুব হাসি পেত দেখলে! ওর পাখিটার খবর কীরে?
—সে ওটা ছেড়ে দিয়েছে বাবা।
তারপর ওরা সেই ফুলের উপত্যকাতে ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে নিল। বড় রাস্তা। তারপরই উঁচুনীচু মাঠ, চন্দনের গাছ, এবং নানারকম লতাগুল্মের বন। বনের ভিতর দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে, একটু বন থেকে বের হলেই সামনে এক বিস্ময়কর দেশ। নানা জায়গায় নানা ফুল। ওরা দূর থেকেই ফুলের গন্ধ পাচ্ছে। এতসব ফুলের গন্ধ মিলে, যেমন গোলাপ, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজ, চামেলি, চাঁপা, বেল ফুল এবং টগর, জুঁই—কত যে সব ফুল এবং ফুলের বাস।
মজুমদার সাব বললেন, টুকুন সুবল এখন একটা দেশের রাজা।
টুকুন বলল, না বাবা, সে রাজা নয়। সে বলে, সে এর কিছু নয়। যারা কাজ করে তারাই সব। এবং সে দেখেশুনে বেড়ায় বলে তার একটু থাকবার জায়গা ওরা দিয়েছে। ওই যে দূরে দেখছ, উঁচু জায়গায় আশ্রমের মতো ঘর, ওখানে সুবল থাকে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না, টংলিং টংলিং শব্দ, দেখতে পাচ্ছ না, তুমি দেখতে পাবে না, ওপাশের রাস্তা দিয়ে একটা ফুলের গাড়ি চলে যাচ্ছে। তোমার কষ্ট হচ্ছে নাতো হাঁটতে? আমি তোমাকে ধরব?
মজুমদার সাবের এই প্রথম মনে হল তাঁর শরীর ভালো নেই। এভাবে হেঁটে যাওয়া ঠিক না, কিন্তু আশ্চর্য তার কষ্ট হচ্ছে না, তিনি বেশ হেঁটে যেতে পারছেন।
মজুমদার সাব বললেন, টুকুন আমি বেশ হেঁটে যেতে পারছি রে।
—আমি তোমাকে ধরব!
—কী বললি!
—তুমি যদি পড়ে টড়ে যাও?
—সুবলটা কোথায়?
—এখন সূর্য অস্ত যাবার সময়। সে হয়তো যারা খাটে তাদের এখন আগামী কাজকর্ম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওদের টাকাপয়সা, সে এখানে নতুন দেশ গড়েছে বাবা। মানুষের জন্য একটা ভালো আবাস তৈরি করেছে।
মজুমদার সাব হেঁটে যাচ্ছিলেন। যেন ভিতরে থাকে মানুষের এক দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছা, সেই শৈশব থেকে স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন। মানুষের মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবার স্বপ্ন, সব তাঁর হয়েছে, অথচ কোথায় যেন তিনি মানুষের চিরটা কাল অনিষ্ট করে বেড়িয়েছেন। সুবলের মতো তার জীবনেও ছিল অসীম দুঃখদারিদ্র্য—তিনি তা জয় করতে গিয়ে এটা কী করে ফেলেছেন! বড় হতে যাওয়ার মানে কেমন বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। সুবলকে দেখে, সুবলের উপত্যকা দেখে তাঁর মনে হল, পৃথিবীতে এভাবে বড় হলে অনেক পাপ থেকে মানুষ বেঁচে যায়। তিনি কেমন এবার দ্রুত হাঁটতে থাকলেন। সেই কুটিরে ওঁর যাওয়া চাই। সেখানে গেলেই বুঝি তিনি আশ্চর্যভাবে ঠিক ঠিক নিরাময় হয়ে যাবেন।
বাইশ
এভাবেই এখানে প্রতিদিন সূর্য ডোবে। ও—পাশের বনের ভিতর মনে হয়, সূর্য হারিয়ে যায়। কখনও হলুদ রঙ নিয়ে, কখনও বেগুনি অথবা নীল নীলিমাতে আগুন ছড়িয়ে সূর্য রোজ ও—পাশের জঙ্গলে হারিয়ে যায়। বনের পাখিরা ডাকে। নদীতে বড় বড় গাছের ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসে এবং এভাবে পৃথিবী ক্রমে অন্ধকার হয়ে ওঠে।