একটু হেসে টুকুন আবার বলল, আমার আর অসুখের ভিতর ফিরে যাওয়া হবে না। এভাবে সারা মাস ঘরে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে আমার অসুখের ভিতর ফিরে যাওয়া ভালো ছিল বাবা। তোমরা আমাকে আর সেখানে যেতে দাও না।
মজুমদার সাব বুঝতে পারেন টুকুন মায়ের উপর অভিমান করে এমন একটা অসুখের ভিতর ফের ফিরে যেতে চাইছে। তিনি বললেন, তুমি ভারী বোকা মেয়ে। বিয়ে হলে দেখবি, এসব অভিমান আর থাকবে না।
টুকুন বলল, বাবা আমার বিয়ের জন্য তোমরা এত ভাবছ কেন। যাকে আমার পছন্দ নয়, তার সঙ্গে কেন তোমরা আমাকে জুড়ে দিতে চাইছ?
কেমন মনটা খারাপ হয়ে যায় এমন কথা শুনলে। কিন্তু মেয়ের জেদ। মজুমদার সাব চুপ করে থাকেন।
টুকুন বুঝতে পারে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বলল, ঠিক আছে তোমাদের যা ইচ্ছা তাই হবে।
মজুমদার সাব সেই বিকেলেই বললেন, তুই যে বলেছিলি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি। সেখানে গেলে আমি ভালো হয়ে যাব।
—তুমি যাবে বাবা?
—যাব। কিন্তু তোর মা যদি জানে!
—তবে তুমি জানো কোথায় নিয়ে যাব তোমাকে?
—জানব না!
—কী করে বুঝলে আমি তোমাকে আমাদের সেই ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যাব?
—পৃথিবীতে মা তুই তো একটা জায়গার কথাই ঠিক জানিস। টুকুন কেমন মাথা নীচু করে রাখল।
—একটু যা মিথ্যে কথা বলতে হবে।
—কী মিথ্যে!
—বলবি, আমাকে নিয়ে তুই হাওয়া খেতে যাচ্ছিস মাঠে।
—বলব।
—বলবি আমরা গ্রাম মাঠ দেখে বেড়াচ্ছি।
—বলব।
—বলবি গ্রাম মাঠের ভিতর দিয়ে গেলে নির্মল বাতাস বুক ভরে নেওয়া যায়।
—বলব বাবা।
—আর বলবি ডাক্তারের পরামর্শমতো সব হচ্ছে।
—বলব।
ডাক্তার এলে মজুমদার সাব ফিস ফিস করে বললেন, একভাবে শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না হে ডাক্তার। সকালে বিকেলে গাড়িতে ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়। এই যেমন ধরো, বেহালার ভিতর দিয়ে গিয়ে যদি ডায়মন্ড হারবার রোডে পড়ি। অথবা ফুলবাগান হয়ে কাঁকুড়গাছি পার হয়ে সোজা সলট লেক, লেক টাউন পিছনে ফেলে এরোড্রাম পার হয়ে বারাসাতের রাস্তায় চলে যাই।
—খুব ভালো। ঘুরে বেড়ান না। এতে যদি মন ভালো থাকে ক্ষতির তো কিছু দেখছি না।
—তুমি একবার তোমার বউদিকে বুঝিয়ে বলো। ও তো বিছানা থেকে উঠতেই দিতে চায় না। ডাক্তার হেসে বলল, বলব।
—আমার টুকুন মা আছে, ভারী সুন্দর গাড়ি চালায়। কাজেই বুঝতে পারছ, আজে বাজে ড্রাইভিং হবে না।
ডাক্তার বলল, ঠিক আছে। আপনার এখন খিধে কেমন?
—কিছু না। এখন মনে হয় হাওয়া খেয়ে পেট যে ভরে প্রবাদটা একেবারে মিথ্যা না।
ডাক্তার কিছু ওষুধ পালটে দিল। টুকুনের মা এলে বলল, বউদি, দাদার একটু বেড়ানো দরকার। বাড়িতে বসে থাকলে মন মেজাজ দুই—ই খারাপ হবার কথা। টুকুন ওঁকে নিয়ে সকাল—বিকেল গ্রাম মাঠ দেখে এলে মনটা প্রফুল্ল থাকবে। দেখা গেছে অসুখ অনেক সময় এভাবে সেরে যায়।
টুকুনের মা বলল, আমার সঙ্গে থাকা দরকার। ঝি—চাকর দিয়ে কী সব হয়! টুকুন কী সব বোঝে!
মজুমদার সাব হেসে ফেললেন, তুমি সেই সেকেলে আছো। এখনকার মেয়েরা অনেক কম বয়সেই সব শিখে ফেলে। কী বলো হে ডাক্তার? টুকুন তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে। সে না পারলে আর কে পারবে।
এভাবেই ঠিক হয়ে যায় টুকুন যাবে। আর যাবে মজুমদার সাব। সঙ্গে থাকবে পুরানো চাকর রামনাথ। ইন্দ্র ঘ্যান ঘ্যান করছিল—সেও যাবে। কিন্তু মজুমদার সাব সব জানেন বলে বললেন, ইন্দ্র তোমাদের ক্লাব এবার সেমিফাইনালে উঠেছে। সবটা তোমার কৃতিত্ব। ফাইনালে ওঠা চাই। আমাদের সঙ্গে বিকেলে কাটিয়ে দিলে দেখবে—ওই পর্যন্ত। এবার যে শিল্ড ঘরে তোলা চাই।
মজুমদার সাব এভাবে বেশ ম্যানেজ করে এক বিকেলে বের হয়ে পড়লেন।
ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর করে তিনি গাড়ি—বারান্দায় এলেন। টুকুন এবং রামনাথ দুপাশে দাঁড়ালে তিনি ওদের কাঁধে ভর করে সিঁড়ি ভাঙলেন! দুপাশে সব বাড়ির এবং অফিসের কিছু আমলা কর্মচারী, ফরাসের লোক খাস খানসাম রামনাথ সবাই মিলে বড়কর্তা বিকেলে যে বের হচ্ছেন এবং মানুষটি অসুখে ভুগলে কী যেন একটা ভয়—এতবড় বাড়ির বৈভব আর থাকবে না, সামনে কৃত্রিম পাহাড়ের পাশে ছোট্ট হ্রদ, হ্রদে কিছু পাখপাখালি এমন শৌখিন বাড়ি এ—তল্লাটে হয় না অথচ এখন এমন বাড়িটা ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। দুবছরের ওপর কারখানা ক্লোজার, দুবছরের ওপর এভাবে সাব বাড়িতে শুয়ে আছেন, দুবছরের ওপর, কারখানার শ্রমিকেরা স্টেশনে স্টেশনে কৌটো ফুটো করে পয়সা মাগছে—এসব দৃশ্য সবার মনে পড়ে গেলে ভারী খারাপ লাগে।
গাড়িতে মজুমদার সাব সামনে বসেছেন। পাশে টুকুন। টুকুনের চুল শ্যাম্পু করা। ঘাড় পর্যন্ত চুল পরিপাটি বিছানো। মনে হয় দেবদেবীর চুলের মতো—কী কোমল আর মিহি, হাত দিলে যেন ছোঁয়া যায় অথবা চুল শ্যাম্পু করা থাকলে আকাশের মতো ভারী দেখায় মুখ। চুলের ভিতর আছে আশ্চর্য এক গন্ধ। টুকুন পরেছে হালকা চাঁপা রঙের শাড়ি। শাড়িতে লতাপাতা আঁকা এবং নানা রকমের বর্ণাঢ্য শোভা—এমন একটা শাড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এবং মজুমদার সাব বেশ লক্ষ্য করে বুঝেছেন, মেয়ের খুব পছন্দ আছে—কী রঙ ওকে মানায় সে যেন জানে। আশ্চর্য স্নিগ্ধ স্বভাবের মনে হচ্ছে টুকুনকে। এবং শাড়ির এমন রঙের সঙ্গে ও শরীরের কোমল আভা অথবা বলা যায় লাবণ্য একেবারে মিলেমিশে গেছে। হালকা প্রসাধন পর্যন্ত। ঠোঁটে যে সামান্য রঙ তাও এত স্বাভাবিক যে মানেই হয় না টুকুন ঠোঁটে রঙ লাগিয়েছে। বরং এটুকু না লাগালেই ওকে যেন এই পোশাকের ভিতর সামান্য শ্রীহীন করে রাখত।