কিন্তু মজুমদার সাব কথাটা ভোলেননি। তিনি দেখলেন খুব বিষণ্ণ মুখে বসে আছে টুকুন। সকালবেলাতে এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে। নাকে মুখে এসে চুল উড়ে পড়ছে। এবং রাতে একেবারে মেয়েটার ঘুম হয়নি বোঝা যাচ্ছে। চোখ ভীষণ ভিতরে ঢুকে গেছে। হয়তো টুকুন ওর মার চেঁচামেচি থেকে টের পেয়েছে, এবাড়ি থেকে তাকে আর একা বের হতে দেওয়া হবে না। এমনকি, গাড়িতে ড্রাইভার থাকবে। সে আর একা ইচ্ছামতো ঘুরতে পারবে না। মেয়েটার জন্য ভীষণ কষ্ট হয় মজুমদার সাবের। অথচ কেন যে মেয়েটা এভাবে একটা ফুলের উপত্যকায় হেঁটে যাবার আকর্ষণে পড়ে গেল। চারপাশে টুকুনের কত সুন্দর সুন্দর ছেলেরা আছে, কত বড় বড় পার্টিতে তিনি মেয়েকে নিয়ে গেছেন অথচ, একেবারে উদাসীন টুকুন। কিছুতেই টুকুন তার বন্য স্বভাব ছাড়তে পারছে না।
মজুমদার সাব বললেন, তুমি এত চুপচাপ কেন টুকুন?
টুকুন বোকার মতো একগাল হেসে দিল। অর্থাৎ বাবাকে সে অভয় দিতে চাইল যেন, কোথায়? আমি তো বেশ হইচই করে আছি বাবা।
মজুমদার সাব এবার হেসে বললেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠব টুকুন।
—তোমার কিছু হয়নি বাবা। ডাক্তারবাবু অনর্থক তোমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
ওমা, একি কথা! এ যে দেখছি টুকুন একেবারে সুবলের মতো কথা বলছে।
টুকুন ফের বলল, তুমি বাজে দুশ্চিন্তা ছেড়ে দাও, দেখবে ভালো হয়ে যাবে!
এখানে যেন টুকুন কোথায় প্রায় ডাক্তারসুলভ কথা বলে ফেলল। সেতো এ—বাড়ির মেয়ে। সে টের পায় সংসারের জন্য বাবাকে অনেক পাপ কাজ করতে হয়। এমন একটি স্ট্যাটাসের ভিতর বাবা উঠে এসেছেন যে তার জন্য তিনি সারাটা দিন কী না করছেন। বাবা কোথায় কীভাবে কী করছেন সে জানে না, কিন্তু বাবার মুখ দেখে সে টের পায়, উদ্বিগ্ন চোখেমুখে বাবার এক অতীব ভয়। সব সময় যেন তিনি জীবনে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। সবকিছু ঠিকঠাক রেখে যাবার জন্য বাবার এই সব পাপ কাজ, বাবাকে খুব সহসা প্রাণহীন করে দিল।
টুকুন বলল, বাবা তুমি একটু ভালো হয়ে ওঠো। ভালো হলে তোমাকে রোজ বিকেলে এক জায়গায় নিয়ে যাব। সেখানে গেলে তুমি নিরাময় হয়ে যাবে।
টুকুন ‘ভালো হয়ে উঠবে’ না বলে ‘নিরাময়’ কথাটা ব্যবহার করল। নিরাময় কথাটা বলতে তার কেন জানি এ—সময় ভালো লাগল।
অর্থাৎ একদিনেই টুকুনের আশ্চর্য বিশ্বাস জন্মে গেছে, মানুষ নিজেই পারে এই আশ্চর্য সুন্দর জগৎ তৈরি করতে—যেখানে মানুষ এতটুকু নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে না। সেখানে সবাই সবার জন্য ভাববে। এবং এমন একটা জগৎ এভাবে তৈরি হয়ে যাবে একদিন। অহেতুক ভয় থাকবে না। ভয় থেকে কোনও অসুখ জন্মাবে না। বাবার অসুখটা সে বুঝতে পেরেছে ভয় থেকে হয়েছে। সব সময় এক ভয়, যা কিছু আছে মানুষেরা লুটেপুটে নিয়ে যাবে।
আবার সে বলল, বাবা ওখানে গেলে সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে।
টুকুনের মার যেন এতক্ষণে মনে পড়ল কথাটা। সে বলল, টুকুন তুমি বড় হয়েছ। এখন আর একা কোথাও যাবে না! বাড়ি থেকে বের হবে না।
টুকুন বুঝতে পারল মা তাকে সেই ফুলের উপত্যকায় যেতে বারণ করছে। কিন্তু সেই ফুলের উপত্যকার কথা মনে হলেই কেমন তার চোখ বুজে আসে। সে যদি যায়, মা ভীষণ অশান্তি করবে। এবং এই অশান্তি বাবার পক্ষে আরও ক্ষতিকারক। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা না বললে আমি আর কোথাও যাব না।
সে বাবার জন্য এই সংসারে কোনও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় না।
এবার টুকুন উঠে ওপরে চলে গেল। সকালে মুখ ধুয়ে সে এক গেলাস ফলের রস খায়। ঘরে গিয়ে দেখল, গীতামাসি সব ঠিক করে রেখেছে। ফলের রস খেতে তার ভীষণ বিস্বাদ লাগল। সে এখন এ বাড়িতে প্রায় বন্দি জীবনযাপন করবে, কোথাও গেলেই মার ধারণা হবে, সেই ফুলের উপত্যকায় সে চলে গেছে!
এভাবে বাড়িতে সে কিছুদিন আটকা পড়ে গেল। হেমন্তের শেষাশেষি বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। কারখানা ক্লোজারের পর খুব বাড়াবাড়ি গেছিল ক’দিন, এখন বোধ হয় ওটা সামলে উঠেছেন। ইউনিয়নের তরফের লোক এসে দেখা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ডাক্তারের দোহাই পেড়ে ওঁর সেক্রেটারি তা ঠেকিয়ে রেখেছেন।
যেমন টুকুনকে নিয়ে বাবা—মা একদিন সব পাহাড়ি জায়গায় শরীর ভালো করবার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, তেমন টুকুন তার বাবাকে নিয়ে নানা জায়গায় ক’মাস থেকে এল। যেমন কিছুদিন ওরা ছিল নৈনিতালে। দেরাদুনেও গেছে। অর্থাৎ এভাবে যাবতীয় পাহাড়ি জায়গায় আশ্রয় নিয়েও যখন দেখেছে বাবার শরীরে সম্পূর্ণ নিরাময়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না তখন ফের ফিরে আসা।
মাঝে মাঝে টুকুন বাবার পায়ের কাছে বসে থাকত। বাবা বুঝতে পারতেন, টুকুন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে ফের। বাবার রুগণ মুখে টুকুন তা ধরতে পারলেই হেসে দিত। বলত, বাবা আমি কত যে চেষ্টা করছি, চুপচাপ আগের মতো শুয়ে থাকলে কেমন হয়, সেই আগের মতো নিঃসাড় পড়ে থাকতে গিয়ে দেখেছি একেবারেই ভালো লাগে না শুয়ে থাকতে। তোমাকে বলিনি বাবা, বললে কষ্ট পাবে, ভেবেছি, কম খেয়ে না খেয়ে শরীর দুর্বল করে ফেললেই আগের অসুখটা ফের আমাকে আশ্রয় করবে। কিন্তু বাবা তোমাকে কী বলব, একবেলা না খেলেই চোখে অন্ধকার দেখছি। তখন গীতামাসিই হেসে বাঁচে না।