—ক্লোজার?
—কিন্তু কী কথায় কী কথা এসে গেল। তোর বউটা আত্মহত্যা কেন করল!
—স্যার বলেছি তো জানি না।
—ঠিক জানিস। তিনি এক ধমক লাগালেন। স্বপ্নে বোধহয় তিনি জানেন, ধমক লাগালে পঞ্চানন তেড়ে আসবে না। অথবা ঘেরাও—র ভয় দেখাতে পারবে না। আর বাছাধন তো বেশ আটকে গেছে কাচের বোয়েমে। এখান থেকে বের হবার আর উপায় নেই।
তিনি বললেন, সব জানিস। পুলিশের ভয়ে এখন মুখে কুলুপ দিয়েছিস।
পঞ্চানন চুপ করে থাকল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। তারপর লাশ, পুলিশ নিয়ে গেলে মিনমিনে গলায় বলল, স্যার পয়সা হলে ফটিনস্টি করার বাসনা হয়।
—সেটা কার?
—বউর।
—তোর হয় না?
—হয়। তবে কাজ করে সময় পাই না। কারখানায় কাজ, ইউনিয়নের কাজ করে ফিরতে বেশ রাত হত। বাড়ি ফিরলে সুমতি খুব সতীসাধ্বী মুখ করে রাখত। মুখ দেখলে কেউ তাকে অবিশ্বাস করতে পারবে না। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, তলে তলে সে বেশ একজন নাটকের লোককে ভালোবেসে ফেলেছে। টের পেলে কত বললুম—তুই ভুল করছিস। তোর ছেলেপুলেদের কথা ভাব। তখন স্যার কী বলব, সুমতি কোনও জবাব দিত না। চুপচাপ সংসারের কাজ করে যেত। যেন আমি মিথ্যা মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলছি। সতীসাধ্বী বলে ওর কিছু আসে যায় না।
এবং যখন ফের আত্মহত্যার কথায় এল মজুমদার সাব, তখন পঞ্চানন দাঁত বের করে হেসে দিল। —হ্যাঁ স্যার, এমন একটা করে ফেলেছি। এবং এভাবেই সংসারে টাকাপয়সা বাড়তি ঝঞ্ঝাট বয়ে আসে। কে যেন এমন বলে যাচ্ছিল। পঞ্চাননের এটা সঠিক টাকা রোজগার নয়। সে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে প্রাপ্যের ঢের বেশি আদায় করেছে। সংসারে এখন এসব টাকায় একটা বাড়তি খরচা তৈরি হয়। এবং এভাবেই পাপ এসে সংসারে বাসা বাঁধে।
পঞ্চানন বলল, স্যার আমরা উদ্যমশীল হলে আমাদের এমন অবস্থা হত না।
খুব ভালো লাগল এমন কথা শুনতে। যাক লোকটার ক্রমে চৈতন্যোদয় হচ্ছে। এবং সেই যে লাঠির ওপর, অথবা মনুমেন্টের মতো একটা উঁচু লম্বা লাঠির ওপর বোয়েমটা ঘুরছে এবং নাটক হচ্ছে প্রতি ঘরে, নাটকের কুশীলবদের চাউনি প্রেতাত্মার মতো দেখাচ্ছে—ওরা সবাই হাড়গোড় বের করা মানুষ, মজুমদার সাব এসব দেখে ঢোক গিললেন। মনে হল বুকে কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে অন্ধকারে দেখলেন, কেউ তাঁর ঘর থেকে সরে যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, জল।
তারপর যা হয় ডাকাডাকি, লোকজন উঠে এলে, সবারই মুখে এক কথা, কী করে এ—ঘরে কেউ ঢুকতে পারে। তিনি বলে চলেছেন, জানো আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে।
এভাবে স্বপ্নের ভিতর একটা ভীষণ অবিশ্বাস দানা বেঁধে যায় মানুষের মনে। মজুমদার সাবকে সকাল বেলাতে কেমন যেন খুব বিমর্ষ দেখাতে থাকল। তিনি আর রাতে ঘুমোতে পারেননি। স্ত্রীকে বলেছেন ডেকে, সে যেন তাঁর পাশে শোয়। পাশে শুলেও ভয়টা কিছুতেই গেল না। কেমন সারারাত চোখ বুজে পড়ে থাকলেন। লাইসেন্সের জন্য মনে খুব উৎকণ্ঠা ছিল। এবং কারখানার লক—আউটের ব্যাপারেও একটা ভয়াবহ টেনসান যাচ্ছে। এসব মিলে তিনি রাতের ঘটনার কার্যকারণ মেলাতে গিয়ে বুঝতে পারলেন—হিসাব ঠিক মিলছে না। তাঁর ভয়টা ক্রমে আরও বেড়ে গেল। সকালে খবর এল, সত্যি গত রাতে গলায় দড়ি দিয়ে পঞ্চাননের বউ আত্মহত্যা করেছে।
এবং এমন খবরেই মজুমদার সাবের আবার কেমন দম বন্ধ হবার উপক্রম। তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। আবার মনে হচ্ছে গলায় শ্বাসকষ্ট। ঠিক রাতের মতো অবস্থা। ডাক্তার এসে বলল, আপনাকে এবার কেবল শুয়ে থাকতে হবে। বিছানা থেকে একদম উঠবেন না। নড়াচড়া একেবারে বারণ।
মজুমদার সাব বুঝতে পারলেন হার্টটা তাঁর একেবারে গেছে। তাঁর হার্টের যখন অসুখ, এবার সংসারে এত যেসব করছেন, কেন যে করছেন, বরং এখন টুকুনকে ডেকে বললে হয়, মা তুই পারবি না, তোর সেই ফুলের উপত্যকাতে নিয়ে যেতে। যেখানে মানুষেরা নিজের জন্য ভারী সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা তৈরি করছে। আমারও ইচ্ছা ছিল এমন। কিন্তু কীভাবে যে আমি একটা কাচের বোয়েমের ভেতরে বাস—করা মানুষ হয়ে গেলাম।
মজুমদার সাব বুঝতে পারছিলেন, ওপরে আবার কেউ নানারকম ঝংকার তুলে নানাভাবে আশ্চর্য সব সিমফনি গড়ে তুলছে। তাঁর ভীষণ ভালো লাগছিল শুনতে। মানুষেরা সব সময় সুন্দর সব সিমফনি গড়তে চায়। গড়ায় স্বপ্ন থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পারে না। কেন যে সে একটা অসুখে পড়ে যায়!
একুশ
সকালবেলা যখন এমন অবস্থা, যখন টুকুন বাবার পাশে বসে আছে এবং টুকুনের মা ভীষণ বিশ্বস্ত মুখে কাজকর্ম করে যাচ্ছে, তখন মনেই হল না, সংসারে স্বামী স্ত্রীতে এতটুকু অবিশ্বাস আছে। বরং অসুখটা যেন দুজনকে সহসা বারমুখী থেকে ঘরমুখী করে দিল। এবং এমন একটা অসুখ নিয়ে মজুমদার সাবকে চিরদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, টুকুনের মা চিরদিন এবার নীরবে মানুষটাকে সেবাশুশ্রূষার সুযোগ পাবে। এত বছর গেছে, এমন একটা সুযোগ যেন তার এই প্রথম। ফলে সে খুব যত্ন নিয়ে দেখাশোনা করে যাচ্ছে। যদিও ইতিমধ্যে দুজন নার্সের কথা উঠেছে, এবং ওদের নিয়োগের ব্যাপারে বাইরের ঘরে কথাবার্তা চলছে তখন টুকুনের মা ভাবছে—এসব নার্স—টার্স কী দরকার, সে নিজেই যখন আছে তখন অনর্থক, নিজের মানুষটাকে পরের হাতে ছেড়ে দেওয়া কেন! তারপরই মনে হল হাতের কাছে কাজের লোক থাকলে মন্দ হয় না। সুতরাং সকালবেলাতে যে একটা জরুরি কথা ছিল টুকুনকে বলার, সেটা বুঝি আর বলা হল না। ইন্দ্রের বাবাকেও যে বলার ছিল কিছু, এখন এই অসময়ে আর কী হবে বলে, বরং তিনি ভালো হয়ে উঠুন, তারপর সব করা যাবে।