বৃদ্ধ পুরোহিত ওদের জল খেতে দেখে, ওদের হইচই দেখে খুব খুশি। দীর্ঘদিন পর জল পান, তৃষ্ণার জল কতদিন পর পান করা গেল। তিনি নিজেও জল এনে গাছের নীচে পান করছেন। মনে হচ্ছিল পেটে আর জায়গা নেই, তবু মনে হচ্ছিল জলের আর এক নাম জীবন, এই জল এবং জীবনকে চেটে চেটে খাবার জন্য তিনি কিছুক্ষণ পর পরই গলায় জল ঢেলে দিচ্ছেন, এবং জল খাবার সময় যেন অন্ধকারে টের পেলেন, ট্রেনটা নড়ছে, ট্রেনটা সহসা এমন গতি বাড়িয়ে দিল যে, তিনি অনুমানই করতে পারলেন না কী করে চোখের পলকে এতগুলো লোক নিয়ে ট্রেনটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
তিনি চিৎকার করতে করতে ট্রেনটার পিছনে ছুট দিলেন। তিনি অন্ধকারেও দেখতে পেলেন সেইসব দুঃখী মানুষদের হাত—ওরা যেন বলছিল, দেখ দেখ, কেমন বেইমান এই ট্রেন, আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। তিনি শুধু চিৎকার করছিলেন, তোরা সব নেমে পড়। তোদের নিয়ে ট্রেনটা চলে যাচ্ছে, তোরা লাফিয়ে পড়।
কিন্তু সুবল ট্রেনের ভেতর জানালাতে সামান্য সময়ের জন্য উঁকি দিয়েছিল। অন্ধকারে গাছপালা আবছা আবছা, সে কোনও মানুষকে কোনও বড় গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখেনি। সে ভেবেছিল হয়তো দু—একজন পড়ে থাকল—আর সকলকে নিয়ে ট্রেনটা মোটামুটি শহরে পৌঁছে যাবে। কারণ এই মন্বন্তর মানুষের আত্মবিশ্বাস হরণ করে নিয়েছে। ট্রেন ছেড়ে দিলে কেউ লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেনি। সকলে যেন মোটামুটি ভিতরে ভিতরে খুশি।
ট্রেনটা ওদেরকে কোনও না কোনও শহরে পৌঁছে দেবে। অন্ন—জল এবং বস্ত্রের অভাব হবে না। একবার শুধু পৌঁছে যাওয়া। সেখানে পুলিশের ভয় সামান্য থাকবে। সুতরাং ওরা সকলেই প্রায় ভদ্রলোকের মতো কামরায় টিকিটবিহীন যাত্রীর মতো বসে থাকল। ওরা আর কিছু তছনছ করছে না। যাত্রীদের মনে সাহস ফিরে এসেছে। ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে বড় নিস্তেজ মনে হচ্ছিল। শরীর শক্তিবিহীন। অনেকের ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম পাচ্ছিল।
সুবল প্রথম শ্রেণীর যাত্রীর ঘরে এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকল। সাদা মোমের মতো বালিকার মুখ। চোখ বড় বড়। সুবলকে বালিকাটি দেখছে। ঘরে অন্য যারা ছিল তারা জল খেয়ে চলে গেছে।
এই কামরায় অবশিষ্ট জলটুকু নিঃশেষ। প্রৌঢ় মানুষটি কী যেন বই পড়ছিলেন। তাকে এখন আর উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তিনি যেন ভেবে নিয়েছেন, এইসব দেহাতি মানুষেরা কোনও কিছু আর অনিষ্ট করবে না। ফাঁক বুঝে জলের জন্য ট্রেন আক্রমণ করতে এসে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে। এক ঢিলে দুই পাখি। রথও দেখা হল, কলাও বেচা হল। সুবলের মুখ দেখে তাই মনে হয়।
সুবল এখন ট্রেনে চড়ে কোথাও চলে যেতে পারছে ভেবে খুশি। অন্তত জলের জন্য আর মাঠ—ঘাট ঘুরে মরতে হবে না। সুবলের মুখ দেখলে তাই হয়। বালিকাটি অসুস্থ। সাদা মোমের মতো মুখে শুধু চোখ দুটোই অবশিষ্ট। চোয়ালে সামান্য মাংস। হাত—পা বড় শীর্ণ। শুধু মুখে সামান্য সতেজ ভাব। চোখ দুটো বড় টল টল করছিল। সুবলের আশ্চর্য লাগছে—এই মুখ, সুন্দর সতেজ মুখ রুগণ এবং পীড়িত। ভিতরে ভিতরে অসামান্য কষ্ট। শিয়রে বসে আছেন যিনি—বালিকাটির মা হবে নিশ্চয়ই। তিনি বুক পর্যন্ত সিল্কের চাদরটা মাঝে মাঝে টেনে দিচ্ছেন। যারা পরে তৃষ্ণার জল খেতে এসেছিল—অবশিষ্ট জল, এমনকি এই রুগণ বালিকার জন্য যে মাটির জারে অল্প জল ছিল, জলের স্বাদ পেয়ে সবটুকু জল খেয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছিল, বালিকার এখন তৃষ্ণা পেয়েছে। বালিকা তৃষ্ণায় জলের জন্য ঠোঁট চাটছে। শিয়রে মা বসে। তিনি উদ্বিগ্ন চিত্তে বললেন, টুকুন জল খেতে চাইছে।
প্রৌঢ় মানুষটি উঠে বসলেন, তিনি দেখলেন জল কোথাও নেই। দরজার গোড়ায় সুবল বসে বসে ঝিমুচ্ছে। এখন আর স্টেশন না এলে জল পাওয়া যাবে না। কোনও বয়কে ডেকে অথবা খাবার ঘরে অনুসন্ধান করলে হয়। তিনি সুবলকে অতিক্রম করে বাইরে বের হতেই দেখলেন বারান্দায় সেইসব দেহাতি মানুষেরা ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছে। কোথাও এতটুকু স্থান নেই যে, তিনি পা ফেলে তাদের অতিক্রম করে যাবেন। এবং এইসব দেহাতি মানুষদের দেখেই মনে হয়, জল কোথাও আর অবশিষ্ট নেই। শুধু এনজিনে জল আছে এবং তিনি ঈশ্বরের নিকট কেমন অন্যমনস্কভাবে হাতজোড় করে ফেললেন। বললেন, ঈশ্বর, এই নির্জন মাঠে ট্রেন ফের থেমে পড়লে মেয়েটাকে আর জল দিতে পারব না। জল না পেলে বড় ছটফট করবে।
সুবল ঝিমুচ্ছিল। সহসা আর্তনাদে সুবলের ঘুম ভাবটা কেটে গেল। সুবল দেখল সেই সুন্দর সতেজ মুখ বালিকার, অথচ চিৎকার করছে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও চলে যাব, কষ্ট আর সহ্য হয় না মা! কী যে এক ভীষণ রোগ মেয়ের, মা পর্যন্ত তার দুঃখে আর্তনাদ করছিলেন।
বড় শহরে যাচ্ছে মা—বাবা, মেয়েকে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে। অথবা মনে হচ্ছিল এই মেয়ের জন্যই মা—বাবা প্রবাস ছেড়ে নিজের দেশে চলেছেন। অনেক ডাক্তার দেখানো হল। জলবায়ু পরিবর্তন করা হল। কত টোটকা, কবিরাজি কি—না করেছেন প্রৌঢ় মানুষটি হায়, মনের অসুখ মেয়ের, কেউ কিছু করতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে বালিকার শুধু জলতেষ্টা পায়।
ছেঁড়া জামা সুবলের গায়ে। সুবলের পরনে প্রায় নেংটির মতো একটু কাপড়। জামাটা হাঁটু পর্যন্ত সুবলের ফুলে—ফেঁপে ছিল। দেখলে মনে হবে, দুটো সুবলকে ভিতরে পুরে রাখা যায়।