—তা কিছু বলছে না।
—তবে কী বলছে?
—মেমসাবকে চাইছে।
—ধরো। আসছি।
তিনি একটা নীল রঙের তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে বেশ ছুটে এসে ফোনটা ধরলেন—হ্যালো কে?
—আমি ইন্দ্র বলছি মেসোমশাই!
—কী ব্যাপার!
—ব্যাপার খুব ভীষণ।
—রাস্তায় আটকা পড়েছ?
—রাস্তায় না, একাডেমিতে। পাশের একটা দোকান থেকে ফোন করছি।
—আটকা পড়েছ মানে?
—টুকুন আমাকে না বলে না কয়ে কখন বের হয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে।
—কোথায় গেছে?
—জানি না।
—কখন গেছে?
—অনেকক্ষণ।
—গেছে যখন, ঠিক ফিরে আসবে। মজুমদার সাব এইটুকু বলে ফোন ছেড়ে দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ইন্দ্র আরও কিছু বলবে। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন সে কিছু বলতে ইতস্তত করছে।
—টুকুন আমাকে বলল, একটু বোসো। আমি আসছি।
—আসছি যখন বলেছে, ঠিক চলে আসবে।
—সে বাড়ি ফিরে যায়নি তো?
—তোমাকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবে কী করে!
—কী জানি, ওর যা মেজাজ।
—কতক্ষণ হল গেছে?
—ঘণ্টা দুইয়ের ওপর হবে।
মজুমদার সাবের মুখ সামান্য সময়ের জন্য খুব উদ্বিগ্ন দেখাল তারপর ভাবলেন কোনও জ্যামে পড়ে গেছে। তিনি বললেন—আজ তোমাদের বের হওয়া উচিত হয়নি। কী করে যে ফিরবে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার তো যাবার কথা ছিল ওদিকে, কিন্তু কিছুতেই যেতে পারলাম না। রাত দশটার আগে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হয় না।
—এদিকে তো শুনছি মাঠে ভীষণ গণ্ডগোল। পুলিশ আর জনতার খুব মারধর হচ্ছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
—তোমার তো দোকানে থাকা উচিত হবে না এ—সময়। টুকুন ফিরে এসে তোমাকে না পেলে ভাববে।
—কিন্তু এমন হওয়া তো উচিত না। কেমন বেপরোয়া। হুঁশ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। সোজা রবীন্দ্রসদন পার হয়ে বাঁদিকে ঘুরে গেল।
—কোথায় যেতে পারে তোমার মনে হয়।
—কী করে বলব। তবে কদিন থেকে বলছিল ওর বাওবাব গাছের খুব একটা দরকার।
—বাওবাব গাছ! সে আবার কী!
—সে আমিও জানি না। সুবল একটা বাওবাবের চারা খুঁজছে।
—কত রকমের যে গাছ আছে পৃথিবীতে!
ইন্দ্র মনে মনে হাসল। মেয়ের মতো বাপেরও বুঝি একটা রোগ আছে। মেয়েটা কোথায় গেল, এতটুকু চিন্তা করছে না। সে এবার বলল—মাসিমা কোথায়?
—এ সময় তো তুমি জানো ও বাড়ি থাকে না। আমিই কেবল অসময়ে বাড়িতে। একটু থেমে বললেন—শোন, তুমি দেরি কোরো না। ও এসে তোমাকে জায়গামতো না দেখলে খুব চিন্তায় পড়ে যাবে।
ইন্দ্র এবার হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। সে বলল—ঠিক আছে, যাচ্ছি। সে মজুমদার সাবকে কিছু বলে চটাতে ভয় পায়। টুকুনের সায় নেই, মেসোমশাইরও সায় না থাকলে ওর হিসাব উলটে যাবে। সে ভয়ে বলতে পারল না টুকুন আমাকে এসে না দেখলে খুব খুশি হবে, সে এতটুকু ঘাবড়ে যাবে না। বললেই যেন সে ধরা পড়ে যাবে—সে খুব অক্ষম, টুকুনকে সে এতদিনেও হাত করতে পারেনি। এবং অন্য যুবকেরা তো বেশ গোড়ালি উঁচু করে দাঁড়িয়েই আছে—এক ফাঁকে এই সাম্রাজ্যের ভিতর কী করে লাফিয়ে পড়া যায়। টুকুনের এক মাস্টারমশাই পর্যন্ত—ছোঁড়া খুব দামি গাড়িতে আসে পড়াতে। মেসোমশাইর কাছে ওর খুব সুনাম! আশ্চর্য যে একজন পেটি শিক্ষক কীভাবেই বা আশা করে টুকুনের মতো মেয়েকে পাবার—তবে যে টুকুনের অসুখ। অসুখ না থাকলে এমনভাবে সে একটা পাখিয়ালার জন্য বাওবাবের চারা খুঁজে বেড়াচ্ছে!
হঠাৎ ইন্দ্রের খেয়াল হল, যা, মেসোমশাই ফোন ছেড়ে দিয়েছে! সে হঠাৎ কী ভাবতে গিয়ে বলতে গিয়ে বলতে পারল না, আমি ঠিক জানি ও কোথায় গেছে! কিন্তু ওটা যে আর বলা হল না! মেসোমশাই ফোন ছেড়ে দিয়েছে। সে আবার ভাবল ডায়াল ঘুরিয়ে বলবে—কিন্তু তক্ষুনি মনে হল টুকুন যদি চলে আসে। সে সত্যি যদি ওকে না দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায়! এমন ভাবতে ইন্দ্রের ভীষণ ভালো লাগে এবং ভালো লাগাটা সে কখনও সত্যি সত্যি মনে মনে মেনে নেয়। কী হবে সব জানিয়ে—মেয়েটার অসুখ বড় কঠিন অসুখ এক—যা সে নিত্যদিন দেখে দেখে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়। কোথাকার এক পাখিয়ালা, কোথাকার এক পেটি শিক্ষক—যারা সহবত জানে না তারা পর্যন্ত টুকুনের কাছে খুব দামি মানুষ।
ইন্দ্র সুতরাং রাস্তা পার হয়ে যায়। সেই গাছটার নিচে গিয়ে বসে থাকে। এবং গাড়িগুলোর যাওয়া—আসার পথে সে কেবল ভাবে—এই বুঝি টুকুন এল। ক্রমে রাত বাড়ে এভাবে। ওর ভালো লাগে না। মাকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলবে ভাবল। মা জিজ্ঞাসা করবে—কী হল, তোকে তো টুকুন পৌঁছে দিয়ে যায়। আজ তোর এমন কথা কেন! সে কেন জানি তার মাকেও বলতে ভয় পায়—মা, টুকুনের অসুখে আমাকে জড়াচ্ছ কেন। মেয়েটা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারপরই মনে মনে ভীষণ রাগ, এবং এক কঠিন মুখ, এ—মুখ যে তার নিজের সে ঠিক তখন বুঝতে পারে না। কেমন নৃশংস মুখ হয়ে যায়। পেটি শিক্ষকের কথা সে ছেড়ে দিতে পারে, তার ওপর সে ভরসা রাখতে পারে; কিন্তু মনে হয় বারবার সে হেরে যাবে একজনের কাছে—তার নাম সুবল—এক পাখিয়ালা। ফুলের রাজ্য তৈরি করে সে এক স্বপ্নের দেশের মানুষ হয়ে গেছে টুকুনের কাছে। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়, টুকুনের স্বপ্নটাকে সে যে ভাবে পারে ভেঙে দেবে। এবং তার আজই ইচ্ছা হল, একবার গোপনে সে সুবলের দেশটা দেখে আসবে—কীসের আকর্ষণ, এমনভাবে তাকে ফেলে পালিয়ে যাবার কী এমন আকর্ষণ! তারপরই কেন জানি সে জোর করে হেসে ফেলে—কীযে সব আজেবাজে সে ভাবছে! টুকুন না বলে গাড়ি নিয়ে গেছে বলে অভিমানে যত সব বাজে সন্দেহ। হয়তো এক্ষুনি এসে পড়বে। কোথাও জ্যাম—ট্যামে আটকে গেছে। তা ছাড়া যদি…..যদি….একটা অ্যাকসিডেন্ট! ওর কেমন ভয় ধরে গেল। এভাবে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। সব খুলে বলা দরকার। একটা ট্যাকসি—এই ট্যাকসি। এভাবে দুবার তিনবার ট্যাকসি ডেকে শেষবার পেয়ে গেলে—সোজা টুকুনদের বাড়িতে। সে এসেই বলল—টুকুন ফেরেনি মাসিমা?