রামনাথ ব্যক্তিগত খানসামার কাজও করে, এ সময়ে সাহেবের ফাইফরমাশ খাটার সে মানুষ, মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়েছিল—কী যে আদেশ করবেন তিনি।
এবং রামনাথ ভাবতেই পারেনি, এমন অসময়ে সাহেব তার কুটিরে ফিরে আসতে পারেন! তার পোশাক—আসাক ভারী বিশ্রী—সে তাড়াতাড়ি প্যান্টের বোতাম আঁটতে ভুলে গেছে। সে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাটেনশান হয়ে। পাগড়ি তার ঠিক ছিল না। স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ হতেই তার মনে হল কী যেন দেখছেন মজুমদার সাব।
সে একটু হকচকিয়ে কেমন বোকার মতো হেসে দিল।
তারপর যা হয়, তাঁর অঙ্গুলি সংকেতই যথেষ্ট। রামনাথ দেখল ওর প্যান্টের বোতাম আলগা। নীচে কিছু পরার স্বভাব নেই বলে এমনটা হয়। সে জানে আরও ক—বার তার এমন হয়েছে। এবং মজুমদার সাবের লাস্ট ওয়ার্নিং ছিল। রামনাথ এখন ভীষণ কুপোকাত। সে বলল—সাব আর হবে না।
মজুমদার সাহেব মনটা ভালো না। তিনি তাঁর এটাচড বাথরুমে এখন ঢুকে বেশ ঠান্ডা জলে স্নান করবেন। তাঁর বাঁধানো দাঁত এখন টেবিলে একটা মোমের বাটিতে ভেজানো থাকবে। এবং তখন কিনা রামনাথ হাতজোড় করে দাঁড়াল। সাহেব কেমন অবাক চোখে তাকালেন। এ—ব্যাপারে যে তিনি একটা লাস্ট ওয়ার্নিং ওকে দিয়ে রেখেছিলেন, বেমালুম ভুলে গেছেন। টুকুনের মা—র ফিরতে অনেক রাত হবে। মিছিল—টিছিলের ব্যাপার দেখিয়ে একটা বেশ অজুহাত তৈরির সুবিধা পেয়ে যাবে।
কারণ এই শহরে মিছিলের পরই জ্যাম আরম্ভ হয়। এবং জ্যাম ভাঙতে ভাঙতে রাত যে কত হয় কত হতে পারে কেউ যেন জানে না। এবং এভাবে টুকুনের মা যত রাত করেই ফিরুক মজুমদার সাহেব কিছু বলতে পারেন না। রাত তাঁরও হয়। তবে তিনি একটা ব্যাপারে খুবই ভালো মানুষ, টুকুনের মাকে খুব ভালোবাসেন। ললিতার মতো মেয়েরা ট্যান্ডন সাবদের মতো মানুষের ভোগে লাগে—মজুমদার সাব সেখানে সামান্য কৌশলী ব্যান্ড—মাস্টার মাত্র।
এবং এভাবে আজকের ব্যান্ড—মাস্টার মজুমদার সাহেব নিজে হয়ে যাচ্ছেন। বাথরুমে স্নান করার সময় তাঁর কথাটা মনে পড়ল। মাথায় শাওয়ারের জল। হাতে নানা রঙের পাথর সব—দামি, ভাগ্য ফেরানোর ব্যাপারে সেই যৌবনকাল থেকে পরে আসছেন। এখন দু—আঙুলে দশটা—ক্রমে বয়েস বাড়লে বিশটা হয়ে যাবে। বাথরুমের আলোটা সাদা মতো দেখাচ্ছে। পেটে চর্বি, এবং লোমশ শরীর থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে টুকুনের মা—র কাছে নিজেকে কেমন একটা বনমানুষ মনে হল। ভাবল, টুকুনের মা—র আসতে দেরি হওয়া স্বাভাবিক। মুখে চোখের ভয়ঙ্কর ঈর্ষা কেমন এক উদাসীন সন্ন্যাসীর মতো হয়ে গেলে আয়না থেকে চোখ তুলে নেন তিনি। খুব সুগন্ধযুক্ত সাবানের ফেনার ভিতর লম্বা টবে শুয়ে শুয়ে ঠান্ডা জলে কী যে ভালো লাগে পাইপ টানতে। এবং অনেক টুকিটাকি কাজ তিনি এভাবে শুয়ে ঠান্ডা জলের ভিতর সেরে ফেলতে পারেন। রামনাথ তখন তাঁর অনেক কাছের মানুষ হয়ে যায়। দরজায় পাহারা—আভি কোই মাত ঢোকনা। সাব নাহানে মে গিয়া।
—রামনাথ।
রামনাথ বুঝল, বাবুর নকল দাঁত এবার তাকে দিয়ে আসতে হবে। অথচ কী যে বয়স। এমন সামান্য বয়সে দাঁত কেন পড়ে যায় সব সে ভাবতে পারে না। সব না এক পাটির কিছু অংশ সে জানে না। এমন একটা মোমের পাত্রে তা ঢাকা থাকে, এবং সে যখন ভিতরে দিয়ে আসে তখন সাহেবের মুখে এমন একটা ফুলো ভাব থাকে যে দেখলে মনে হবে তাঁর একটা দাঁতও পড়েনি এবং রামনাথ জানে না, মেমসাব আজও জানে কিনা, দাঁত নকল না আসল। কনফিডেনসিয়াল সব। সে এ—ঘরের টুঁ শব্দটি দরজার বাইরে বের হতে দেয় না। এখানে এই স্নানের সময়টুকু স্নানের ঘরে ঢুকলেই তাঁর বের হতে হতে দু—ঘণ্টা—রামনাথের মনে হয় ঠান্ডা জলে কীসব গন্ধদ্রব্য একটার পর একটা ঢেলে, তিনি আশ্চর্য এক নীল সমুদ্রের বাসিন্দা হয়ে যেতে চান। সে তখন যেই খোঁজ করুক না—সাব নাহানে মে হ্যায়। ব্যাস তার এক কথা। এমনকি তখন মেমসাব কেমন সন্তর্পণে চলাফেরা করেন। তিনি পর্যন্ত ঢুকে বলতে সাহস পান না, আমি দেখব, দাঁত আসল না নকল।
তারপর যা হয়ে থাকে…নকল দাঁতের শৌখিনতা মানুষের মনে সেই কবে থেকে যেন। সে জানে বোঝে নকল দাঁতেরা খুব উজ্জ্বল হয়। পুরানো দাঁত পরে থাকতে বুঝি ভালো লাগে না মানুষের। উজ্জ্বল দাঁত পরে, হাসিটুকু উজ্জ্বল রেখে, সব সময় মানুষ তার নিজের গোড়ালি উঁচু রাখতে চায়। এবং এর ভিতরই থেকে যায় অসুখটা। টুকুনের ছিল—কিন্তু মজুমদার সাব অথবা মেমসাহেবের কোনও অসুখ নেই কে বলবে। প্রাচুর্য অনায়াস হলে মানুষের নকল দাঁতের দরকার হয়। মজুমদার সাব এটা যে বোঝেন না তা নয়, খুব বোঝেন। উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ—উদ্যমই সব। অথচ কোথায় যে মানুষেরা উদ্যম বিহনে ভুগে ভুগে অনায়াস প্রাচুর্যের লোভে কখনও মিছিলের ভিতর, কখনও কারখানার ভিতর, আবার কখনও বড় বাড়ির সদরের এক কঠিন অসুখ—আর, এভাবে একটা ঐতিহাসিক তত্ত্বের মতো ঘটনাটা আবিষ্কার করে কেমন তিনি উৎফুল্ল হলে, দরজার ও—পাশে ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠল।
তিনি রামনাথের গলা পাবেন আশা করে বসে আছেন—কে রে? তিনি রামনাথকে উদ্দেশ করে বাথরুম থেকে বললেন।
—সাব ইন্দ্র দাদাবাবু।
—ইন্দ্র দাদাবাবু।
—হ্যাঁ সাব।
—ছোঁড়াটা জ্যামে পড়ে গেল বুঝি!