টুকুন বলল, এভাবে সুখী মানুষটা পরিশ্রম ছেড়ে দিয়ে দুঃখী মানুষ হয়ে গেল।
এবং এভাবেই টুকুনের মনে হয় তার বাবাও ভীষণ কষ্টের ভিতর পড়ে গেছে। বাবার জীবনের সঙ্গে কাঠুরিয়া জীবনের কোথায় যেন সাদৃশ্য আছে। টুকুন বলল, জানো বাবার জন্য আমার ভারী কষ্ট লাগে। কাঠুরিয়ার মতো বাবাও আমার দুঃখী মানুষ। বাবাও আমার আরও কত গাড়ি, কত বাড়ি বানানো যায়—সেই আশায় একটা বড় রেলগাড়িতে চড়ে বসে আছে। কিছুতেই নামতে চাইছে না।
সুবল সহসা অন্য কথায় চলে এল। বলল, কোথায় যে একটা চারা পাই। ওটা পেলেই আমার এ—ফুলের উপত্যকা ভরে যাবে। আমার আর কিছু লাগবে না।
টুকুন বলল, আমিও গাছ খুঁজছি। বাবাও খুঁজছেন।
কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় গাছটা আসলে পৃথিবীতে নেই।
তারপর ওরা আর কোনও কথা বলল না। চুপচাপ বসে থেকে এই সব বন উপবনের নানারকম বর্ণাঢ্য শোভার ভিতর ডুবে গেল। ওরা শুনতে পাচ্ছে—কীটপতঙ্গেরা সব ডাকছে। পাখিরা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। খরগোসেরা দল বেঁধে শস্যদানা খাবার লোভে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। আরও কত কী—কী যে আশ্চর্য মহিমময় এই পৃথিবী। অথচ কখন সোনার চাঁপা ফুটবে, সেই আশায় একটা গিরগিটির মতো গাছের ডাল দেখছে কাঠুরিয়া। চারপাশে তার এতবড় পৃথিবী, আর এমন সুন্দর দিন গাছপালার ভিতর বর্ণাঢ্য সব শোভা নিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে জানতেও পারছে না। লোভ তাকে সব কিছু থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
টুকুনের আজ এখানে এসে কেন জানি মনে হল, মানুষেরা ক্রমে গিরগিটি হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর দিনগুলি তারা আর ঠিক ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। কাঠুরিয়ার মতো বনে—জঙ্গলে শুয়ে আছে, কখন সোনার চাঁপা ফুটবে গাছে, আর খপ করে তুলে নেবে। তারা কিছুতেই পরিশ্রমী হবে না। পরিশ্রমী না হলে সুন্দর দিনেরা মানুষের কাছ থেকে ক্রমে সরে যায়।
এই ফুলের জগতে সুবলকে দেখে কেবল টুকুন কেমন এখনও সাহস পায়। সুন্দর দিনগুলো ঠিক ঠিক কোথাও একসময় আবার এভাবে ফিরে আসে। এবং এভাবে মানুষের পৃথিবীতে আরও অনেকদিন বেঁচে থাকে।
উনিশ
তখন শহরে মিছিল যাচ্ছে। মিছিলের স্লোগান—ঘেরাও চলছে, চলবে। স্লোগান, আমাদের দাবি মানতে হবে।
বড় বড় লাল শালুতে দাবির ঘোষণা। বেশ বড় বড় করে লেখা—বেতনের একটা নিম্নতম হার।
পথের ধারে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে চেয়ে এক ভিখারিনি, পাগলিনি—প্রায় ভীষণ হাসছিল। আর হেঁকে হেঁকে বলে যাচ্ছিল—দু ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর।
মজুমদার সাহেবের ড্রাইভার বলল—স্যার, আর এগুনো ঠিক উচিত হবে না।
মজুমদার সাহেবের ড্রাইভার খুব পুরানো লোক। এবং কী হবে না হবে সেটা তার মনে করিয়ে দেবার স্বভাব। সে বলল—মিছিল শেষ হলেই গাড়ি জ্যামে পড়ে যাবে।
মজুমদার সাহেব টুবাকো টানেন। পাইপে ধোঁয়া উঠছে না। তিনি বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে ফের কটা টান দিয়েও যখন দেখলেন ধোঁয়া উঠছে না, তখন কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। ক্লাবে আজ একটা বড় রকমের লাইসেন্সের লেনদেনের ব্যাপার আছে। ট্যান্ডন সাব আসবেন। তাঁকে খুশি করার ব্যাপারও একটা আছে। মিস ললিতাকে সেজন্য তিনি ফোনে বলে রেখেছিলেন, আর রাস্তায় নেমে এমন একটা বিশ্রী ব্যাপারের ভিতর আটকে যাওয়া। তিনি কেমন বিরক্ত মুখে বললেন—দিন দিন এসব কী হচ্ছে বুঝি না।
ড্রাইভার বলল—স্যার বরং গাড়ি বাড়িতে নিয়ে যাই।
কোনো উপায় নেই বুঝতে পারলেন। কেবল তারা যাচ্ছে। আর চারপাশে গাড়ির হর্ন। এভাবে ক্রমে এই রাস্তা একটা গাড়ির পিঁজরাপোল হয়ে যাবে কিছুক্ষণের ভিতর। তিনি যে এখন কী করেন। তাঁর হাত—পা কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে। অথবা এই সব মিছিলের মানুষদের ধরে শহরের বাইরে বের করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তিনি বললেন—দ্যাখো ব্যাক করতে পারো কিনা।
এবং তখনই পাগলিনি হেঁকে হেঁকে যাচ্ছে—দু—ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। হাতে তার লাঠি। লাঠির মাথায় পালক। পাগলিনিকে ভীষণ দাম্ভিক মনে হচ্ছে। মজুমদার সাহেব বললেন—দ্যাখো পাশ কাটাতে পারো কিনা।
তারপর ফিরে এসে ফোন। প্রোগ্রাম ক্যানসেল। ভিতর বাড়িতে এ—সময় কারও থাকার কথা না। টুকুনের যাবার কথা আছে একাডেমিতে। ইন্দ্রকে নিয়ে যাবে। এখন টুকুন ভীষণ ভালো গাড়ি চালাতে পারে। ওঁর ইচ্ছা হাতের সব কাজ হয়ে গেলে একবার গাড়িতে স্বামী স্ত্রী টুকুন সবাই কাশ্মীর যাবেন। খুব জমবে। টুকুনের মা নিশ্চয়ই দরিদ্র—বান্ধব ভাণ্ডারে চাঁদা আদায়ের জন্য মিঃ তরফদারের কাছে গেছে। সেখান থেকে ফিরতে ওর রাত হবার কথা।
অথচ এমন একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে মনটা খচ খচ করছিল। তবে তিনি ট্যান্ডন সাবকে জানেন ভীষণ লোভী মানুষ। আশ্চর্য সৎ টাকাপয়সার ব্যাপারে। এক পয়সা ঘুষ তিনি নেন না কথিত আছে। তবে যে দেবতা যাতে খুশি। ললিতা সম্পর্কে এমন একটা ছবি তৈরি করে রেখেছেন ট্যান্ডন সাবের মনে যে তাঁর আর সূর্যাস্ত না দেখে উপায় নেই। নদীর পারে খোলামেলা বাতাসের ভিতর একটা নিরিবিলি গাছের ছায়ায় ট্যান্ডন—সাব আর ললিতা। সব ব্যবস্থা মজুমদার সাহেব নিপুণভাবে করে রেখেছেন। অথচ এই সময়টায় কিনা মিছিলের লোকগুলি—কাজ না করে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে পয়সা কামাতে চায়! কী যে স্বভাব মানুষের এবং এটা বাঙালিদের ভিতর খুব বেশি এমন মনে হলে তাঁর কেন জানি মনে হয় আর এ বাঙালি জাতিটাকে বাঁচানো গেল না।