এভাবে ওরা কথা বলতে বলতে অনেকদূর চলে এসেছে। সামনে সেই ছোট্ট নদী। যেমন ছোট্ট উপত্যকা নিয়ে সুবলের ফুলের চাষ তেমনি ছোট্ট নদী নিয়ে, ছোট্ট একটা বন নিয়ে সুবল বেশ আছে। আর কী নির্মল জল নদীতে। টুকুন নেমে বাবার সময় দুপাশের জমিতে দেখল অজস্র অপরাজিতা ফুটে আছে। নানারকম বাঁশের মাচান ছোট ছোট। সেখানে ফুলের লতা বেয়ে বড় হচ্ছে সজীব হচ্ছে। একেবারে সবুজ রঙ, ফুলের রঙ নীল, ভিতরটা শঙ্খের মতো সাদা। এবং টুকুনের ইচ্ছা হল এ—ফুলের একটা লম্বা মালা গাঁথে। ফুলের সৌরভ নেই কোনও। অথচ কী সুন্দর নরম ফুলের মালা। এমন মালা হাতে গলায় পরে সর্বত্র ঠিক নূপুরের মতো বেঁধে কেমন সেই যেন শকুন্তলার প্রায় তপোবনে তার ঘুরে বেড়ানো। টুকুন বলল, আমি নদীতে সাঁতার কাটব।
—অবেলায় সাঁতার কাটলে অসুখ হবে।
টুকুন বলল, আমি তুমি সাঁতার কেটে সুবল ওপারে উঠে যাব। বনের ভিতর হারিয়ে গিয়ে দেখব, কী কী গাছ আছে। তুমি গাছের নাম বলে যাবে, আমি গাছ চিনে রাখব। কত বড় হয়েছি, অথচ দ্যাখো কোনটা কী গাছ ঠিক চিনি না।
সুবল বলল, বনের ভিতর গেলে আমার কেবল ভয় হয় তুমি বনদেবী হয়ে যাবে।
—তা হলে কী হবে?
—তুমি আমাকে লোভে ফেলে দেবে।
—সে আবার কী।
—সে একটা লোভ। সোনার চাঁপাফুল। পেলে আর ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। তখন অসুখটা বাড়ে।
টুকুন দেখেছে, সুবল চিরদিন এভাবেই কথা বলেছে। কথায় কেমন হেঁয়ালি থাকে, সে কখনও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অথচ মনে হয়, সুবল যা বলে তা সত্যি। সে বলল, সোনার চাঁপাফুলটা কী?
—সে একটা লোভ দিদিমণি।
—সেটা কী?
—সেটা এক কাঠুরিয়ার গল্প।
—কে বলেছে?
—আমাদের বুড়োকর্তা।
—তবে শুনতে হয়। বলে সে শাড়ি সামান্য তুলে নদীর জলে সামান্য নেমে গেল। বালির জন্য পা দেবে যাচ্ছে না। কী সুন্দর আলতা পড়েছে টুকুন দিদিমণি। জলের নীচে পায়ের পাতা মাছরাঙার মতো দেখাচ্ছে। সুবল এমন দেখলেই কেমন লোভে পড়ে যায়। ওর শরীর ফুলের সৌরভের মতো কাঁপে। সে টের পায় চোখ মুখ কেমন জ্বালা করছে। কিন্তু টুকুন দিদিমণিকে সে কেন জানি ছুঁতে ভয়। কীসব আশ্চর্য সুবাস শরীরে মেখে রাখে! কী নরম সিল্ক পরে থাকে, আর কী রঙবেরঙের লতাপাতা আঁকা পোশাক! সবটা এমন যে সে ভালো করে চোখ তুলে কখনও কখনও দেখতে ভয় পায়। এবং এমন হলেই সুবল বলে, বেশ ছিল কাঠুরিয়া। টুকুন একটু জল অঞ্জলিতে নিয়ে কী দেখে ফেলে দেবার সময় বলল, কী বেশ ছিল?
—এই তোমার বেশ ছিল। সে পরিশ্রমী মানুষ ছিল। কাঠ কাটত। কাঠ বিক্রি করত। কাঠ বিক্রির পয়সায় চাল ডাল এবং সবাই রাতে বেশ পেট ভরে খেত। তারপর কী ঘুম। কোনো হুঁশ থাকত না। তার কোনও রোগভোগ ছিল না।
টুকুন বলল, সে তবে সুখী লোক ছিল?
—খুব। সে নদী পার হত সাঁতরে। গায়ে তার অসুরের মতো শক্তি। সে তার পরিশ্রমের বিনিময়ে খাদ্য পোশাক এবং আশ্রয় পেত। একটু থেমে সে বনের দিকে চোখ তুলে কী খুঁজল। তারপর বলল, বুড়োকর্তা বলেছে, এটাই নাকি ঈশ্বরের বিধান। তার পবিত্র পুস্তকে বুঝি এমনই লেখা আছে। সে এখানে একটু সাধুভাষায় কথা বলার চেষ্টা করল। কাঠুরিয়া ঈশ্বরের নিয়ম থেকে সরে গেল। বনদেবী তাকে লোভে ফেলে নিরুদ্দেশে গেল।
টুকুন দেখল কেমন উদাসীন চোখে সুবল ওকে দেখছে।
—কী দেখছ সুবল?
—তোমাকে দেখছি টুকুনদিদিমণি। কাঠুরিয়া তারপর থেকে ফুলটার জন্য রাতে ঘুম যেতে পারত না।
—আমাকে দেখে সেটা তোমার মনে হল?
—তোমাকে দেখে কিনা জানি না, আজকাল আমার মাঝে মাঝেই এমন হয়।
—সেজন্য আমাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছ!
—ছেড়ে ঠিক দিইনি। যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তোমার মা এজন্য ভীষণ কষ্ট পায়। কেউ কষ্ট পেলেই আমার খারাপ লাগে। বলে সে বালির চরের দিকে হেঁটে যেতে থাকল। ওপারের বনের ছায়া ক্রমে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ওদের দুজনের ছায়াও বেশ লম্বা হয়ে নদীর চর পার হয়ে যাচ্ছে। ওরা পাশাপাশি হাঁটছিল। একজনের শরীরে শহরের সুগন্ধ। অন্য জন ফুলের সৌরভ শরীরে মেখে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই বলা, কাঠুরিয়ার তখন বড় ভয় হয়, সেই চাঁপাফুলটা কে না কে চুরি করে নিয়ে যায়!
—কার আবার দায় পড়েছে—কে জানে যে বনে সোনার চাঁপা ফুটে থাকে।
—জানতে কতক্ষণ। সে তো ততদিনে লোভে পড়ে গেছে। সে শহরে যায়—স্যাকরার দোকানে ফুলটা বিক্রি করে, ওরা লোক লাগাতে পারে—দ্যাখো তো রোজ মানুষটা ফুল পায় কোথায়? সেজন্য সে রোজ এক দোকানে চাঁপাফুল বিক্রি করে না, আজ শহরের উত্তরে গেলে, কাল দক্ষিণে। এভাবে সে চিন্তাভাবনায় বড় উদ্বিগ্ন থাকে। সে একদিন দেখতে পায় আয়নায়, সব চুল পেকে যাচ্ছে, মাথার চুল উঠে যাচ্ছে। সে কেমন অল্প বয়সে বুড়ো মানুষ হয়ে যাচ্ছে। আর যা হয় সে চাঁপা ফুলটা চুরি যাবে বলে, রাত না পোহাতে বনে চলে যায়। তারপর বনের পাতালতার ভিতর নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকে। চারপাশের পোকামাকড়েরা ওকে কামড়ায়। সে ভ্রূক্ষেপ করে না। সে তো জানে না এভাবে লোভের কীটেরা তাকে দংশন করে ক্রমে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
সুবল এবার বালির চরে বসে পড়ল। এখন ওদের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে নেই। বরং ছায়াহীন এক মাঠ, দূরাগত পাখির ডাকের মতো তাদের কেমন নির্জন পৃথিবীতে যেন নিয়ে এসেছে। সুবলের যা হয়, এমন এক নিরিবিলি নির্জন পৃথিবীতে বসে থাকলেই বুঝি তার ভালো ভালো কথা বলতে ভালো লাগে। সেজন্য বোধহয় সাধুভাষায় কথা বলতে পারলে ভীষণ খুশি হয়। সে বলল, টুকুনদিদিমণি কাঠুরিয়া দিন—রাতের বেশি সময়টাই বাড়ির বাইরে থাকত। সে যখন ফিরত শহর থেকে গাড়িতে, তাকে বড় ক্লান্ত দেখাত। ফিরে এসে দেখত, বউ তার রেলগাড়িতে চড়ে কোথায় গেছে। ছেলেরা বলত, মায়ের ফিরতে রাত হবে বলে গেছে বাবা।