টুকুন দেখল, সত্যি এটা একটা আলাদা দেশ। যেন দুঃখ দৈন্য বলে এখানে কিছু নেই। কেবল ফুলের আশ্চর্য সৌরভ। এবং এই সৌরভের ভিতর বসে আছে এক বৃদ্ধ মানুষ। টুকুন মুখে আঙুল রেখে ইশারা করল অর্থাৎ যেন বলছে এটা ঠিক হবে না সুবল, মানুষটা প্রার্থনায় মগ্ন, তখন এসো তুমি আমি বসে ওকে চুপচাপ দেখি।
আর তখন সুবল এসে পাশে বসলে বেশ সুন্দর দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়। এক বুড়ো মানুষ বয়স যে কত, কে জানে তার সঠিক বয়স কী, সে নিজেও হয়তো জানে না, তার বয়স বলে কিছু আছে, এই পৃথিবীর যেন সে আদিমতম মানুষ, সুন্দর করে এই পৃথিবীর শেষ ঘ্রাণ শুষে নিচ্ছে। এখন তাকে দেখলে এমনই মনে হয়।
কিছু কাঞ্চন ফুলের পাপড়ি তখন ঝরে পড়ছিল ওদের ওপর। হাওয়ায় দুটো একটা পাপড়ি বেশ উড়ে উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। কেমন একটা বাতাসের হিল্লোল। ক—দিন আগে বৃষ্টিপাতের দরুন দারুণ সবুজ আভা, এবং তার ভিতর অজস্র ফুলের সুবাস এসে যেন যথার্থ এক অন্য গ্রহাণু সৃষ্টি করছে।
আর তখন সেই মানুষ যদি চোখে দেখতে পেত তবে একটা ছবির মতো মেয়ে ঘাসের ওপর বসে আছে। স্থির। নিশ্চল। এতটুকু নড়ছে না। সুবলকে পর্যন্ত চেনা যাচ্ছে না এবং বুড়ো মানুষটা এভাবে বুঝতে পারে তার কাছে সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গা, এই ফুলফলের উপত্যকা। যা কিছু সুখ, যা কিছু আকাঙ্ক্ষা সব সে এর ভিতর ঈশ্বরপ্রাপ্তির মতো টের পায়। সে কিছুটা অনুমানের ওপর বলল, তোরা।
—আমরা চাচা।
—এই তোর সেই মেয়েটা।
সুবল হাসল।—কোন মেয়েটা?
—যে মেয়েটা ভাবত, আর বাঁচবে না।
—হ্যাঁ চাচা সেই মেয়ে।
—এখন কী ভাবছে মেয়ে?
—আমি আপনাকে দেখছি। কিছু ভাবছি না।
টুকুন দুষ্টুমেয়ের মতো কথা বলল।
—আমাকে। আমি তো বুড়ো মানুষ।
সুবল বলল, চাচা কিন্তু দেখতে পায় না।
টুকুন বলল যাঃ।
—হ্যাঁ।
—তবে আমাদের যে বলল, তোরা!
—ওর আর একটা ইন্দ্রিয় তৈরি হয়েছে। সে টের পেয়ে যায়। তার এই নিজের হাতে তৈরি ফুলের উপত্যকাতে কে এল কে গেল। কোন গাছে কী ফুল ফুটেছে সে এই কাঞ্চন ফুল গাছটার নীচে বসে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে।
টুকুন বলল, আমার অসুখ, আমি বাঁচব না, আপনাকে এমন কে বলেছে?
বুড়ো মানুষটার যা স্বভাব, দাড়িতে হাত বোলানো এবং যেন এভাবে বলে যাওয়া—টুকুন সুবল তো কাজের ফাঁকে জল আনার সময়, অথবা সব আগাছা বেছে দেবার সময় কেবল একজনের কথাই বলে থাকে—সেতো তুমি। তোমার নাম টুকুনদিদিমণি। তুমি বিছানাতে একটা মমির মতো শুয়ে থাকতে। সুবলের মুখ দেখলে তখন বুঝতে পারতাম—সে নানাভাবে তোমাকে নিরাময়ের চেষ্টা করছে। ঠিক সে যেমন এই ফুলের উপত্যকায় এসে চারপাশে যা কিছু আছে, সব কিছু নিয়ে মগ্ন হয়ে গেল, তেমনি সে মগ্ন ছিল, তুমি কী কী করলে আনন্দ পাবে—সুবল কতভাবে যে তখন এই সব মাঠে বড় বড় নানা বর্ণের ফুল ফোটাবার চেষ্টা করেছে। সুবল তোমার জন্য সবচেয়ে দামি ফুলের গুচ্ছ নিয়ে যেত। এভাবে আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। ঈশ্বরের পৃথিবীতে তুমি একটা অসুখে ভুগছিলে। অসুখটা ছিল তোমার মনের। তোমার বড় বেশি ছিল বিশ্বাসের অভাব। তোমার সব আকাঙ্ক্ষা মরে যাচ্ছিল। সুবল আবার তোমাকে আকাঙ্ক্ষার জগতে ফিরিয়ে আনল—তার কাছে তুমি একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। কতদিন বলেছি তোর টুকুনদিদিমণিকে আসতে বলিস এখানে। দেখে যাক—পৃথিবীর আর একটা ছোট জায়গা আছে—যেখানে মানুষেরা কেবল ফুল ফোটায়। মানুষ তার নিজের স্বভাবেই সুন্দর পৃথিবী গড়তে ভালোবাসে।
টুকুন বলল, চাচা তুমি সত্যি দেখতে পাও না।
—যাঃ দেখতে পাব না কেন! এখন আমি সবচেয়ে ভালো দেখি। এতদিন যা আমার চোখের আয়ত্তে ছিল তাই দেখতাম। এখন তো আরও দূরের জিনিস এই ধর হাজার লক্ষ মাইল দূরে এই সৌরলোকের কিংবা মহাবিশ্বের কোথায় কী আছে সব যেন নিমেষে দেখে ফেলি। সুবল আমাকে যে ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প শুনিয়েছিল আমি এখন তার মতো এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে নিমেষে চলে যেতে পারি। কোনও কষ্ট হয় না। না দেখলে কী করে টের পেতাম তুমি আজ আমার বাগানে এসেছ।
এভাবে এক বুড়ো মানুষ তার ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে এখন সব কিছু দেখতে পায়। আগে সুবল ওর কোরান শরিফ পাঠের জন্য একটা ছোট্ট মতো কাঠের র্যাক করে দিয়েছিল। বিকেল হলেই বুড়ো মানুষটা কাঞ্চন ফুলের গাছটার নীচে গিয়ে বসত। চোখে ভারী কাচের চশমা লাগিয়ে সে নিবিষ্ট মনে পড়ে যেত সুর ধরে। তার সে নানারকম ব্যাখ্যা শোনাত সুবলকে। সুবল বসে বসে শুনত সব। একটু মনোযোগের অভাব দেখলেই ধমক লাগাত। ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ থাকবে না কেন? আল্লা ঈশ্বর তো আলাদা নন।
সুবল বলল, এখন সময় পাই না। এখন শুক্রবারে চাচার জন্য নীলপুর থেকে আসে আক্রম খাঁ। সে সারাটা দিন নামাজের ফাঁকে ফাঁকে চাচাকে কোরান পাঠ করে শোনায়।
টুকুন বলল, আর কীভাবে দিন কাটে তোমার?
—আমার এভাবেই দিন কেটে যায়।
সুবল কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। পাশে টুকুন হাঁটছে। ফুলের সৌরভের কাছে টুকুনদিদিমণির দামি প্রসাধন কেমন ফিকে হয়ে গেছে। সে বলল, এটা শ্বেতকরবী। বলে সে কটা ফুল হাতে তুলে নিলে টুকুন বলল, আমাকে দাও।
এবং টুকুন ফুল কটা নিয়ে খোঁপায় গুঁজে দিল। ববকাট চুলে আজ নকল চুল বেঁধে খোঁপা করেছে দিদিমণি। এবং খোঁপায় ফুল গুঁজে দিলে টুকুনদিদিমণিকে আর শহরের মেয়ে মনে হয় না, কেমন এক বনের দেবী হয়ে যায়। ওর বড় ইচ্ছা একদিন সে টুকুনদিদিমণিকে নিয়ে ও—পারের বনে যায়। এবং সারাদিন বনের ভিতর চুপচাপ বসে থাকা, অথবা গল্প, দিদিমণি আর কী কী নূতন বই পড়েছে, সুবল তো বই পড়তে পারে না, টুকুনদিদিমণির সঙ্গে দেখা হলেই নানারকম গল্প শোনার ইচ্ছা এবং টুকুনদিদিমণি কীযে সব সুন্দর সুন্দর পৃথিবীর খবর নিয়ে আসে। তার ইচ্ছা বনের দেবীকে ঠিক একদিন বনে নিয়ে যাবে। এবং বনের ভিতরে ছেড়ে দিয়ে সেই যে সে একজন কাঠুরের গল্প শুনেছিল, কাঠুরে রোজ কাঠ কাটতে যেত বনে, এবং দেখতে পেত এক ছোট্ট মেয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, সে মেয়েকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে যেত, ফলে তার কাঠ কাটা হত না, সে কাঠ না কেটেই চলে আসত এবং এভাবে সংসারে তার ভারী অভাব—অথচ সে দেখে বনের ভিতর রোজই মেয়েটা রাস্তা হারিয়ে ফেলে, এবং তাকে গ্রামের পথ ধরিয়ে দিতে হয়। কাঠুরিয়ার কাঠ কাটা হয় না। এবং এভাবে কাঠুরিয়া জানে না, এক বনের দেবী তাকে নিয়ে খেলা করছে। তারপর সে অভাবের তাড়নায় আর বাড়ি ফিরে না গেলে একটা ফুলের গাছ দেখিয়ে বলেছিল ছোট্ট মেয়েটা, একটা চাঁপা ফুল রোজ এ—বনে ফুটবে। সেটা তুই নিয়ে যাবি। সে কথামতো চাঁপা ফুল বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখেছিল—চাঁপা ফুল স্বর্ণ চাঁপা হয়ে গেছে। একটা ফুল বিক্রি করলে তার অনেক টাকা হয়ে যায়। সে রোজ বনে এসে সেই ফুলটা কখন ফুটবে সেজন্য বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে মনে হয়, এই বনের কোথায় যেন এক শ্রীহীন রূপ ফুটে উঠেছে। সেই মেয়েটি, যে তাকে নিয়ে খেলা করে বেড়াত তাকে না দেখতে পেলে বুঝি ভালো লাগে না, এই চাঁপা ফুল তুলে নিয়ে গিয়ে সে রোজ রোজ কী করবে। সেই মেয়েটা তাকে যে এভাবে বেল্লিক করে দেবে সে ভাবতেই পারে না। সে দেবীর দেখা পেয়েও পেল না। সে বলত, বনের দেবী তুমি আমার কাছে এমন ছোট্ট হয়ে থাকলে কেন। বনের দেবী তুমি আমাকে এমন লোভে ফেলে গেলে কেন। আমার যে এখন হাজার অভাব। বেশ ছিলাম মা জননী, কাঠ কাটা, কাটা কাঠ বেচে পয়সা, স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মিলে আহার—তারপর সন্ধ্যা হলে আমার বউ পিঁদিম জ্বালাত। আমার সুখ ছিল, স্বস্তি ছিল। এখন মা জননী এত টাকা আমার, অথচ দ্যাখো বউটার মোটরগাড়ি না হলে চলে না। এবং সেই গল্প মনে হলে সুবলের মনে হয় টুকুনদিদিমণি বনের দেবী হবে ঠিক, কিন্তু ছোট মেয়ে সেজে তার লোভ বাড়াবে না। সে বলল, দিদিমণি ওপারে একটা সুন্দর বন আছে। যখন কিছু ভালো লাগে না, নদী সাঁতরে আমি ওপারে বনে উঠে যাই। চুপচাপ গাছের নীচে বসে থাকি।