এবং এভাবে সে যখন চারপাশে তাকায়—দেখতে পায় সব রাস্তার ধারে ধারে গন্ধরাজ ফুল। গ্রীষ্মকাল চলে যাচ্ছে। বর্ষা আসছে। ক’দিন আগে খুব বৃষ্টি হয়েছে। ফল ফুলের গাছগুলো ভীষণ তাজা। সে নতুন কলম করছে গোলাপের। গোলাপের ডাল কেটে সে মাথায় গোবর ঠেসে দিয়ে কাদামাটিতে পুঁতে রেখেছে। সামান্য বৃষ্টি পেয়ে কাটা ডালগুলো কুঁড়ি মেলেছে। সে এসব দেখতে যায়। এদিকটায় রাস্তার দুপাশে সব বড় বড় গন্ধরাজ ফুলের গাছ। গাছের পাতা কী আশ্চর্য সবুজ। এবং চারপাশে গাছের সাদা ফুল। নীচে নুড়ি বিছানো পথ। বৃষ্টিতে এতটুকু কাদা হয় না। সবুজ ঘাস রাস্তার ওপর। এবং হেঁটে টের পাওয়া যায় বুড়ো মানুষটার টালির বাড়ি অথবা ওর ঘরটা এবং এই চাষবাস মিলে জায়গাটা যেন একটা পুরানো কুঠিবাড়ি হয়ে গেছে। কত সব আশ্চর্য কীটপতঙ্গ উড়ে এসে বাসা বেঁধেছে। কিছু সোনা পোকা পর্যন্ত সে এই ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছগুলোর চারপাশে আবিষ্কার করেছিল। এবং এখানে উড়ে এসেছে নানাবর্ণের পাখি। আর এসেছে ছোট্ট সব খরগোস, কাঠবিড়ালি। এখানে এসে যেই সবাই জেনে ফেলেছে—সুবলের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা খুব আনন্দের।
আর এভাবেই সুবল তার এই পৃথিবীতে ছোট রাজপুত্রের মতো বেঁচে থাকতে চায়। সে আর যায় না টুকুনদিদিমণির বাড়িতে। সে টের পায় তাকে নিয়ে ভীষণ একটা ঝড় উঠেছে টুকুনদিদিমণির বাড়িতে। সে টের পেয়েই গত দু রোববার একেবারে ডুব মেরেছে। এমনকি বড় শহরে ফুল নিয়ে গেলে পাছে তার লোভ হয় একবার টুকুনদিদিমণির সঙ্গে দেখা করার, সেজন্য সে নিজে আর শহরে যাচ্ছে না। স্টেশন পর্যন্ত গিয়েই ফিরে আসে। ফুলের সব বিক্রি বাট্টা, যারা কাজ করে তাদের ওপর। ওর যেন কেবল ইচ্ছা সে কত বড় ফুল আর কত বেশি ফুল চাষবাস করে তুলতে পারছে, এবং এভাবে সে সবার জন্য এবং নিজের জন্য অর্থাৎ এই যে ঈশ্বর পরিশ্রমী হতে বলছে, সে কতটা পরিশ্রমী হতে পারে তার যেন একটা প্রতিযোগিতা। বস্তুত সে চাইছিল কাজের ভিতর ডুবে গিয়ে টুকুনদিদিমণির কথা ভুলে যেতে।
সুতরাং বিকেল হলেই যখন তার লোকেরা গাছে গাছে জল দিয়ে যায়, যখন জমির আগাছা বেছে নবীন উঠে দাঁড়ায় এবং বুড়ো মানুষটার ছবি কাঞ্চন ফুলের গাছটার ছায়ায় ভেসে ওঠে—তখন সে গাছের পাতায় পাতায়, ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে জীবনের সৌরভ খুঁজে বেড়ায়। ভাবতে অবাক লাগে টুকুনদিদিমণির ওপর তার ভীষণ একটা লোভ আছে। ঠিক সেই অজিতদার স্ত্রীর মতো যেন। এবং এভাবে সে মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভেবে ফেলে। যত তার বয়স বাড়ছে, টুকুন দিদিমণির ওপর তত তার লোভ বাড়ছে। এবং এটা টের পেলেই সে আর এইসব ফুলেরা যে সৌরভ নিয়ে বেঁচে থাকে তা মনে করতে পারে না। এবং শেষটায় সে দিশেহারা হয়ে গেলে কঠিন অসুখের ভিতর যেন সেও পড়ে যায়। সে বলল, যেন নিজেকে শুনিয়ে বলল—আমি খুব খারাপ মানুষ টুকুনদিদিমণি। এতদিনে আমি এটা টের পেয়েছি।
আর তখনই সেই উপত্যকার ওপাশে যে একটা বড় রাস্তা চলে গেছে, মনে হল সেই রাস্তায় একটা গাড়ি এসে থেমেছে। এখন বিকেল। সূর্যাস্তের সময় গাছপালার ভিতর দিয়ে রোদ লম্বা হয়ে পড়েছে। গাড়িটা নীল রঙের। ভীষণ ঝকঝকে। আর সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। ফলে সূর্য তার আশ্চর্য লাল রং নিয়ে এক্ষুনি গাছপালার ওপর ছড়িয়ে যাবে। এবং এমন একটা সৌন্দর্যের ভিতর হালকা সিল্কের পোশাক পরে যদি কেউ ফুলের উপত্যকায় নেমে আসে—যেখানে কেউ নেই, আছে সুবল, আর বুড়ো মানুষটা, তার যত রাজ্যের নানাবর্ণের ফুল, নদীর নির্মল জল। ওপারে বন। বনের গাছপালা ভীষণ নিবিড় তখন সুবল অপলক না তাকিয়ে থাকে কী করে! ক্রমে অনেকটা হেলে দুলে সে যেন চলে আসছে। সুবল দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে কিছুটা স্বপ্নের মতো লাগছে। সে চোখ মুছে ভালো করে দেখছে সব। সে মুগা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। পায়ে তার ঘাসের চটি, এবং সে আজ ধুতি পরেছে। বিকেল হলেই স্নান করার স্বভাব সুবলের। সে বেশ পরিপূর্ণ সেজেগুজে যখন নদীর ঢালুতে একটু চুপচাপ বসে থাকবে ভাবছিল, যখন ফুলের গাড়িটা টংলি টংলি শব্দ তুলে মাঠের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তখন কিনা আশ্চর্য সুন্দর এক মেয়ে প্রায় যেন রাজকন্যার শামিল, পায়ের গোড়ালির ওপর সামান্য শাড়ি তুলে প্রায় যেন ধীরে ধীরে উড়ে আসছে।
সুবল কাছে এলেই বুঝতে পারল, টুকুনদিদিমণি।
সুবল এবার হাত তুলে গন্ধরাজের ডাল ফাঁক করে ডাকল টুকুনদিদিমণি।
টুকুন, চারপাশে তাকাল। সে সুবলকে দেখতে পাচ্ছে না। সুবল যে গন্ধরাজ ফুলের গাছগুলোর ভিতর চুপচাপ অদৃশ্য হয়ে আছে টুকুন টের পাচ্ছে না। সে চিৎকার করে বলল, সুবল তুমি কোথায়?
—আমি এখানে টুকুনদিদিমণি।
—আমি যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না সুবল।
—তুমি আমাকে দেখতে না পেলে হবে কেন। কাছে এসো। কাছে এলেই টের পাবে আমি ঠিক এখানে আছি।
কী ভীষণ প্রতীক্ষায় মগ্ন চোখ মুখ টুকুনের। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেবল ফুল আর ফুল। কত যে ফুল ফুটিয়ে রেখেছে সুবল। সুবল যে গন্ধরাজ গাছগুলোর পাশে পাশে হাঁটছে টুকুন টের পাবে কী করে। সে তো কেবল দেখছে, ফুল আর ফুল। আর দেখছে, বড় একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ। সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। নীচে পরিপাটি করে কিছু বিছানো। এবং বুড়ো মতো একজন মানুষ বসে আছে। বরফের মতো, সাদা দাড়ি, পরিপাটি সাদারঙ গায়ে লম্বা আলখাল্লা, পরনে খোপকাটা লুঙ্গি, মাথায় সাদা টুপি। হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। মুখ কী প্রসন্ন। হাত সামনে রেখে সে আছে মাথা নীচু করে। চুল এত সাদা যে দূর থেকে একটা বড় কদমফুলের মতো লাগছে। আর আশ্চর্য মানুষটা ওর গলার স্বরে এতটুকু বিচলিত হচ্ছে না। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। নিবিষ্ট মনে বুঝি ঈশ্বর চিন্তা করছে। এমন ঈশ্বর চিন্তায় মানুষ কখনও এত মগ্ন থাকে সে যেন টুকুনের জানা ছিল না। সে বুঝতে পারল—এই সেই বুড়ো মানুষ। সুবল যার গল্প কতবার করেছে। বলেছে, টুকুন দিদিমণি আমার দেশটা তোমার রাজপুত্রের ছোট গ্রহাণুর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।