সুবলের কামরায় খুব অল্প মানুষ। সুখী মানুষ, তাঁর স্ত্রী এবং রুগণ এক বালিকা নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। এতবড় কামরা—রিজার্ভ প্রথম শ্রেণীর কামরা, মাত্র তিনজন মানুষ। রুগণ বালিকা মোমের মতো সাদা। সাদা চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। মাথায় আলো জ্বলছিল। খুব অনুজ্জ্বল আলো। ওরা সকলে ভয়ে কেমন চোখ—মুখ সাদা করে রেখেছে। বালিকাটি পর্যন্ত মুখ—নাক দেখে আঁৎকে উঠেছে। সুবলের পিছনে বড় বড় সব মানুষ। মানুষ বলে চেনা যায় না। যেন বড় এক রাজপুরী। সুন্দর সব বাদামি রঙের গাছ। গাছে হিরে—পান্নার ফুল। নীচে রাজকন্যা আঙুর খেতে খেতে কোনও রাজপুরের জন্য অন্যমনস্ক। অথবা এও হতে পারে রাজকন্যার জানা ছিল না, রাজ্যের কোথাও দুর্ভিক্ষ হচ্ছে। জানা ছিল না, রাজ্যের রাজা বনের হরিণ অনুসন্ধানে মত্ত। রাজা, রাজ্যের খবর রাখছে না। হাজার হাজার গ্রামে মড়ক লেগেছে। অনাবৃষ্টির জন্য ফসল ফলছে না। অল্প বৃষ্টির জন্য মাটি ক্রমশ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। হায়, তখনও রাজা মনোরম রাজপ্রাসাদে নূতন অরণ্যের সৃষ্টি করছে। কারণ ওর প্রিয় হরিণটি এই বনের ভিতর হারিয়ে যাবে। সে সেই হরিণের জন্য শুধু ব্যস্ত থাকবে। রাজকার্যের জন্য বনের হরিণটি ওর বড় প্রিয়। মরীচিকার পেছনে ছোটার মতো রাজা শুধু ছুটছেন। তখন রাজকন্যা দেখতে পেল হাজার হাজার কঙ্কালপ্রায় মানুষ তাকে ঘিরে ফেলেছে, হাউ মাউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ—এই সব কথা বলছে।
সুবল হাতের ইশারা করলে সকলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুখী মানুষটি প্রথম খুব চেঁচামেচি করছিল, পুলিশের ভয় দেখাচ্ছিল। কিন্তু এতবড় নির্জন মাঠ, একদিকে দীর্ঘ পাহাড়, অন্যদিকে এক মরা নদী, নদীতে মানুষগুলো জলের জন্য দিন নেই, রাত নেই মাটি খুঁড়ে চলেছিল, অথচ জল নেই, জল নেই, হাহাকার জলের জন্য। সুতরাং সামান্য পুলিশের ভয় সুবল অথবা এইসব কঙ্কালপ্রায় মানুষদের এতটুকু বিচলিত করতে পারল না।
বরং মানুষগুলো, সুদৃশ্য এই কামরা, আসবাবপত্র দেখে কৌতুকবোধ করতে থাকল। ওরা সুবলকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে। অথবা সুবলকে অনুনয়ে বলছে, ওরা এই কামরার ক্ষতি করবে না। শুধু ঢুকে দেখবে, মোটা গদি, এবং আলোর কাছে হাত রেখে দেখবে—কেমন ভিতরে অনুভূতি জন্মায়। সুবল ওদের এক এক করে জল খেতে দিচ্ছে, আর এক এক জন কামরার ভিতর ঢুকে দেওয়ালে হাত রাখল, অথবা একটু আরাম করে গদিতে বসে শুয়ে কেমন লাগে দেখতে থাকল। বা বেশ তো, ওদের কেউ কেউ যেন চোখ বুজে আরামটুকু অনুভব করছে। বাংকের ওপর বসে, হাঁটু মুড়ে বসে শুধু চারিদিকের দৃশ্য,—জানালা দিয়ে শুধু অন্ধকার মাঠ, পেছনের করিডোরে মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে, কোলাহল করছে। গার্ডের লালবাতি, যেন মাঠ, মরা নদী অথবা শুকনো পাহাড়ের উদ্দেশ্যে লালবাতি জ্বেলে বসে আছে।
কামরার ভিতর সুখী মানুষ, তাঁর স্ত্রী এবং রুগণ বালিকা ভয়ে থর থর করে কাঁপছে, ওরা ভয়ে কামরার এক পাশে, যেন ভয়ঙ্কর কোনও দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আছে ওরা।
ড্রাইভার নীচে নেমে দেখল, পিপীলিকার মতো মানুষগুলো কামরায় কামরায়, ছাদের ওপরে উঠে হৈহুল্লোড় করছে। শিশুদের মতো চিৎকার, যেন এই ট্রেন ওদের কাছে খেলনার মতো অথবা যুদ্ধে প্রতিপক্ষের পরিত্যক্ত কামান, কামানের গোলাগুলি শেষ, গ্রামের দুষ্ট বালকবালিকারা কামানটা টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার যাত্রীদের পার হয়ে গার্ডের ঘরে গিয়ে দেখছে, ভয়ে গার্ডসাহেব লালবাতি জ্বেলে বসে রয়েছে।
এবার ড্রাইভার মরিয়া হয়ে বলল, এবার নীলবাতি জ্বালুন, ট্রেন ছেড়ে দিই, একটা মানুষও লাইনের ওপর আর নেই। শালা সকলকে নিয়ে এবার স্টেশনে নিয়ে ফেলি।
ড্রাইভারের চিৎকারে গার্ডসাহেব ভয়ে তিড়িংবিড়িং করতে থাকল। ঘুরেফিরে কেমন মাতালের মতো কিছুক্ষণ নেচে বেড়াল। ড্রাইভার বুঝল গার্ডসাহেব ভয়ে ভিরমি খেয়েছে। সে বলল, গার্ডসাহেব, বেশি দেরি করলে বয়লার থেকে জল ঢেলে নেবে। ট্রেন তবে আর চলবে না!
গার্ডসাহেব কী যেন ভাবলেন। এদের এত তেষ্টা?
—তেষ্টা, কী যে জল খাচ্ছে! কেবল জল খাচ্ছে।
—কেবল জল খাচ্ছে?
—কেবল জল খাচ্ছে। জল খাচ্ছে। জল খাচ্ছে। কেবল জল খাচ্ছে।
—অন্য কিছু না?
—না, কিছু না। কোনোদিকে আর ভ্রূক্ষেপ নেই। বড় সজ্জন।
—তবে এবার শালা সজ্জনদের চল শহরে নিয়ে তুলি। বলে তিনি বসে টুক করে লাল বাতিটাকে নীল করে দিলেন।
ড্রাইভার নামার সময় বলে এল, আপনি সাব হুইসল বাজাবেন না। আমি সেকেন্ডে এমন গতি বাড়িয়ে দেব না, শালা একটাকেও নামতে দেব না। বলে ড্রাইভার অন্ধকারের ভিতর নিচু হয়ে হাঁটতে থাকল। এবং দেখল ট্রেনের নীচে আবার কেউ বসে রয়েছে কিনা। সে কোনো মানুষ দেখতে পেল না। কেবল মনে হল নীচে ঠিক বড় একটা গাছের অন্ধকারে একজন আলখাল্লা পরা মানুষ দাঁড়িয়ে দুঃখী লোকদের যেন জলপান দেখছে।
ড্রাইভার বলল, শালা, তুমি লিডার আছে। তোমাকে ফেলে দেখ শালা, কেমন সব ফাঁক করে দিই। তুমি শালা এখানে পড়ে পড়ে এবার ঘাস খাও। মুরগি খাও। মুরগির নাম মনে হতেই ড্রাইভারের জিভে জল এসে গেল।
ওদের এত জলতেষ্টা যে, কোথায় ড্রাইভার, কোথায় ফায়ারম্যান দেখবার ফুরসত নেই। আর এতগুলো মানুষ একসঙ্গে ট্রেনে উঠে পড়বে সেও, কেউ ভাবেনি।