ইন্দ্র দেখছে, টুকুন অনেকক্ষণ কিছু কথা বলছে না। কেমন চোখ বুজে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে।
ইন্দ্র বলল, কী ভাবছ টুকুন?
—ভাবছি, সুবল এখানে কোথায় বাওবাব পাবে?
—ইন্দ্র বলল, বাওবাব মানে?
—বা তুমি জানো না, বাওবাব এক রকমের গাছ, খুব পাতা, ওর শেকড় অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়।
—এমন গাছের নাম তো আমি জীবনে শুনিনি বাবা।
—টুকুন কেমন অবাক হল, বলল, বলছ কী, তুমি বাওবাব গাছের নাম জানো না! সে কী!
ইন্দ্র বলল, সুবল তোমার মাথাটি বেশ ভালো ভাবে খেয়েছে।
—তুমি ইন্দ্র যা জানো না, তা বলবে না।
—তবে কে এসব খবর দিচ্ছে তোমাকে।
—কে দেবে? বইয়ে এসব লেখা আছে।
—কোন বইয়ে?
টুকুন ওর সেই বইটার নাম করলে ইন্দ্র বলল, ওগুলো রূপকথা।
টুকুন বলল, মানুষের জীবনটাতো রূপকথার মতো। তাই না! এই যে সুবল কে কোথাকার মানুষ, এখন ফুলের গাছ কেবল লাগায়। কত রকমের সে ফুল নিয়ে আসে।
ইন্দ্র কেমন খেপে গেল এসব শুনে। মাসিমা ঠিকই বলছেন, তোমার একটা অসুখ সেরে আর একটা হয়েছে।
টুকুন লাফ দিয়ে উঠে বলল—সেটা কী?
—এই যে তুমি সব রূপকথা বিশ্বাস করছ।
—তোমরা বুঝি কর না?
—আমরা কী করি আবার?
—অনেক কিছু কর। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবছে মা। ইন্দ্র এবার কেমন মিউ মিউ করে জবাব দিল, সেটার সঙ্গে রূপকথার কী মিল আছে?
—মায়ের কাছে এটা রূপকথার শামিল। মা তোমাকে নিয়ে খুব স্বপ্ন দেখছে। অথচ জানো, মা জানে না, আমি বিয়ে—থা করছি না।
—সেটা তোমার ইচ্ছায় হবে বুঝি?
—কার ইচ্ছায় তবে?
—মাসিমা মেসোমশাইয়ের।
টুকুন উঠে দাঁড়াল। কী যেন খুঁজছে মতো। সে বলল কোথায় যে সুবল বাওবাব পাবে। নদীটা ওর ফুলের জমি ভেঙে নিচ্ছে। বাওবাবের চারা নদীর পাড়ে পাড়ে লাগিয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হত। ওর শেকড় অনেক দূর চলে যায়। ছোট্ট গ্রহাণুর পক্ষে যা খুব খারাপ পৃথিবীর পক্ষে তা খুব দরকারি।
আঠার
রাত থাকতেই সুবলের ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। তখন আরও চার—পাঁচ জন লোক আসে। ওরা একসঙ্গে কাঁচি দিয়ে চারপাশ থেকে, যেসব ফুল ঠিকমতো ফুটে গেছে, আর বড় হবে না, সে—সব ফুল তুলে নেয়। প্রত্যেকের সঙ্গে বেতের ঝুড়ি থাকে। ফুলটা রেখে দেবার সময় খুব যত্নের দরকার হয়। রাস্তায় চার—পাঁচটা ছোট গাড়ি থাকে। গাড়িগুলো ছোট রেলগাড়ির মতো দেখতে। গাড়িতে বেশ নানাভাবে চৌকো মতো ঘর। এবং এক—একটা ঘরে ছোট ছোট ফুলের চুবড়ি সাজানো। কেবল রজনিগন্ধার ডাঁটগুলো সে আঁটি করে বেঁধে রাখে। মাঝে মাঝে ফুলের ওপর জল ছিটিয়ে দিতে পারে। সে অন্ধকারেই বুঝতে পারে কোথায় কে কী করছে। বেশ বড় এই ফুলের উপত্যকা। নদী ঢালুতে নেমে গেছে। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে লাল ইঁটের দেয়াল এবং টালির ছাদের ঘরটা আশ্চর্য মায়াবি মনে হয়। সে অন্ধকারেও টের পায় জল তুলে আনছে সবুর মিঞা। সে ভারে জল আনছে। নিতাই তোলা ফুলে জল দিয়ে যাচ্ছে। কালু এখন তৈরি, যাবে স্টেশনে ফুল নিয়ে। সে অবশ্য ইচ্ছা করলে গাড়ি নিয়ে শহরে চলে যেতে পারে। কখনও কখনও দেরি হয়ে যায়, তখন অন্য জায়গা থেকে ফুল চলে আসে, ফুলের দাম ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। ভোর রাতে যে গাড়িটা যায় এবং যে গাড়িতে এ অঞ্চল থেকে ডাব, মুরগি, হাঁস ডিম যায় শহরে, সেই গাড়িতে সুবল তার সব ফুল তুলে দেয়। দালালদের ফুল দিলে সে ঠিক পড়তা করতে পারে না। মোটামুটি ফুলের কারবারে অনেক মানুষ জন খাটছে। এবং মাইল দুই গেলে, এক জনপদ গড়ে উঠেছে। ফুল সব মানুষদের—এ অঞ্চলের, এমনকি যারা শহরে গেছিল—তারা পর্যন্ত ফিরে এলে তাদের নিয়ে বেশ একটা ফুলের চাষবাস করে দিলে বুড়ো মানুষটা খুব খুশি।
সে বুড়ো মানুষটার জন্য একটা বড় কাঞ্চন গাছের নীচে বেদি বাঁধিয়ে দিয়েছে। দিনের নামাজ বুড়ো সেখানে করে নেয়। রাতেও সেখানে মানুষটা নামাজ পড়ে। এবং চারপাশে থাকে তখন সাদা কাঞ্চন ফুল। বিকেলে কোনও কোনও দিন গাড়িতে ফুল যায়। তখন সুবল বেশ সুন্দর একটা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, পায়ে সাদা কেডস এবং হাতে কিছু রজনিগন্ধা নিয়ে যখন গাড়ির মাথায় বসে থাকে, বুড়ো মানুষটার মনে হয়, সুবল যাচ্ছে ফুলের গাড়ি নিয়ে—সুবল না হলে এমন একটা ফুলের গাড়ি কে যে চালায়। যখন দু—পাশে মাঠ এবং ঘাস মাড়িয়ে গাড়ি যায়, সাদা কাঞ্চন গাছটার নীচে সে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ এক উজ্জ্বল রোদ খেলা করে বেড়ায়। নদী থেকে হাওয়া উঠে আসে। এবং সুন্দর এক জীবন। এভাবে যখন মানুষেরা টের পায় ফুলের জমিটা ওদের—কী আপ্রাণ উৎসাহ তাঁদের তখন পরিশ্রম করার।
কোনও কোনওদিন সে ফুল নিয়ে স্টেশন যায় না। দুপুরের খাবার অথবা রাতের খাবার এখন কালু তৈরি করে দেয়। সে যতটা সময় এসব করবে, ততটা সময়ই তার নষ্ট। সে চাষবাসের কথা তখন ভালো করে ভাবতে পারে না। সেজন্য সে যখন বিকেলে চুপচাপ ফুলের উপত্যকা ধরে হেঁটে যায় তখন চারপাশের সব কিছু কেমন স্নিগ্ধ হয়ে যায়। সে এভাবে একটা নিজের পৃথিবী গড়ে তুলেছে। সবাই চায় তার নিজের একটা পৃথিবী থাক। সবাই চায় সেই পৃথিবীর সে রাজা হয়ে থাকবে। যেমন বুড়ো মানুষটা ফুলের চাষ সম্পর্কে প্রায় রাজার মতো, যেমন জনার্দন চক্রবর্তী তার বিশ্বাস সম্পর্কে প্রায় ঈশ্বরের শামিল—সুবল যেমন একসময় ভাবত, টুকুনদিদিমণি মরে যেতে পারে, এমন মেয়ে অসময়ে মরে গেলে ভীষণ কষ্টের।