এটা চড়াই পাখি না সুবলের পাখি রাতের বেলায় টের পাওয়া কঠিন। এবং কঠিন বলেই পাখিটা নিজের খুশিমতো কার্নিশে বসে বেশ ডেকে চলেছে। সে বুঝতে পারছিল বুঝি বেচারা টুকুনের মা বেশ বিপাকে পড়েছে। এই বিপাক থেকে রক্ষা পাবার কী যে উপায় স্থির করতে না পেরে খুব অস্থিরচিত্ত হয়ে গেছে।
এবং এভাবে টুকুনের সঙ্গে মাত্র রবিবার এক বিকেলে, একটা বিকেলই মাত্র সুবল থাকে তার সঙ্গে। সপ্তাহে এসময়টা টুকুনের খুব মনোরম। সে যেন এসময়টার জন্য সারাটা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে। আজ শনিবার ইন্দ্র ওকে রেড রোডে নিয়ে এসেছে। রেড রোডে ইন্দ্র গাড়ির স্টিয়ারিং টুকুনের হাতে দিয়ে বেশ চুপচাপ বসে আছে। টুকুন নানাভাবে বেশ অনায়াসে গাড়ি চালাতে পারছে বলে ইন্দ্রের ভাবনা কম। আর টুকুন সেই স্ল্যাকস এবং ঢোলা ফুলহাতা সার্ট অর্থাৎ ফুলফল আঁকা সিল্কের পাতলা পোশাক পরে বেশ অনায়াসে গাড়ি চালিয়ে মাঠের চারপাশে, কখনও গঙ্গার ধারে ধারে আবার এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসের পাশ দিয়ে এবং মেডিকেল কলেজ ঘুরে সোজা ফুলবাগান পার হয়ে ভি—আই—পি। তারপর আরও সোজা লেক টাউন, কেষ্টপুর এবং দমদম বিমান ঘাঁটি ডাইনে ফেলে কোনও গ্রামের ভিতর গাছের ছায়ায় সহসা গাড়ি থামিয়ে দিলে মনেই হয় না কিছুকাল আগেও এ—মেয়ের কথা ছিল মরে যাবে। আগামী শীতে অথবা বসন্তে মরে যাবে। সুবল এসে ঠিক এক জাদুকরের মতো তাকে কী করে যে ভালো করে তুলেছে?
এভাবে টুকুন আজ বিশ্বাসই করতে পারে না, তার একটা অসুখ ছিল। সে যে শুয়ে থাকত সব সময় এবং হেঁটে যেতে পারত না, এমনকি দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল, কিছুতেই সে তা বিশ্বাসই করতে পারে না। সে যেন এমনই ছিল। তার কথা ছিল অনেক দূর যাবার। ঠিক মানুষের খোঁজে সে আছে। ইন্দ্র চেষ্টা করছে ওর পাশে পাশে থাকার। কিন্তু ইন্দ্রকে সে এখনও তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। ইন্দ্রকে পাত্তা দিলে মা খুব খুশি হবে—অথচ সে কেন যে পারে না। বেশ এই যে গাছের নীচে সে এবং ইন্দ্র বসে আছে, ইন্দ্র ফ্লাস্ক থেকে টুকুনকে চা ঢেলে দিচ্ছে, সবটাই কেমন আলগা মানুষের মতো ব্যবহার। এবং চা ঢেলে দেবার সময় ইন্দ্র দেখল, কী সুন্দর আঙুল, চাঁপার ফুলের মতো ছুঁয়ে দিলেই কেমন মলিন হয়ে যাবে—আর বাহুতে কী লাবণ্য—এবং টুকুনকে এত বেশি ঐশ্বর্যময়ী মনে হয় যে, একটু ছুঁতে পেলেই—সব হয়ে যায়—সে এই ভেবে টুকুনের পাশে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলে, টুকুন বলল, তুমি আমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবে?
—কোথায়?
এমন একটা জায়গা, যেখানে কেবল ফুল ফোটে।
—জায়গাটা কোথায় আমার চেনা নেই।
সুবল সেখানে থাকে।
—সেই ফুলয়ালা সুবল!
সেই ফুলয়ালা সুবল, কথাটা তার ভালো লাগে না। সুবল সম্পর্কে সে আরও কিছু বলতে পারত, কিন্তু ইন্দ্র এই নিয়ে ঠাট্টা—তামাশা করবে। মাকে গিয়ে বলবে। সুবলকে নিয়ে ঠাট্টা—তামাশা তার ভালো লাগে না। মার কাছে সুবল একটা শয়তানের মতো। সুবলকে কীভাবে জব্দ করা যায়, অথবা সুবল একটা উইচ, সে মন্ত্রের দ্বারা বশ করেছে টুকুনকে, এসব গ্রাম্য লোকেরা নানারকমের তুকতাক জানে, এমন এক সুন্দর রূপবতী কন্যা আর ধন—দৌলত দেখে টুকুনকে সুবল বশীকরণ করেছে, এসব মা সব সময় ভেবে থাকে। আত্মীয়স্বজনের কাছে মা এসব বলে না। কেবল ইন্দ্রের বাবা এলে মা সব বলে। কী যে করা এখন। কারণ মার ইচ্ছা কোনও শুভ দিনে ইন্দ্র এসে ওর হাত ধরুক এবং এই যে কলকাতা শহর, রাস্তাঘাট, অথবা মেম
রিয়েল—কখনও কখনও উটকামাণ্ড একটা বড় নীল উপত্যকায় ইন্দ্রের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, এসব হলেই মা ভাবে টুকুন নিরাময় হয়ে যাবে। টুকুনের একটা অসুখ ছেড়ে আর একটা অসুখ এবং এটা মার কাছে ভীষণ অসুখ। বরং মার ইচ্ছা টুকুন আবার শুয়ে থাকুক, সে আর উঠতে না পারলে কোনও কষ্টই যেন নেই তার, তবু যে পারিবারিক সম্ভ্রম বজায় থাকে। মেয়েটা যা করছে, কিছুতেই পারিবারিক সম্ভ্রম আর রাখা যাচ্ছে না। মার হতাশ মুখ দেখলে টুকুন তা টের পায়।
টুকুন দেখল, বেশ একটা জায়গা, এমন নিরিবিলি জায়গায় তার বসে থাকতে ভালো লাগে। কাল সুবল আসবে। সুবল বলেছে, একটা বাওবাবের চারা পেলেই লাগিয়ে দেবে তার উপত্যকায়। এবং গাছটা ডালপালা মেলে ধরলে টুকুনকে নিয়ে যাবে। টুকুনকে এসেই যা সব গল্প করে তার ভিতর থাকে, কেবল বুড়ো মানুষটা। নদীতে যে সে সাঁতার কাটে তাও বলে থাকে এবং কখনও তার কিছু ভালো না লাগলে নদীর ওপারে যে বন আছে, বনের ভিতর সে একা একা হেঁটে বেড়ায়—সে সব কথাও বলে।
অথবা টুকুনের ভারী সুন্দর লাগে যখন সুবল বলে, মাঠের ভিতর শীতের জ্যোৎস্নায় ভাত ডাল রান্না ও মাছের ঝোল রান্না। জ্যোৎস্নায় কলাপাতা বিছিয়ে ঘাসের ওপর বিছিয়ে খাওয়া ভারী মনোরম। এসব বললে, টুকুনের সেই ছোট্ট রাজপুত্রের মতোই মনে হয়, সুবল এমন একটা দেশের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে যেখানে তাকে আজ হোক কাল হোক চলে যেতেই হবে। সুবল কলাপাতা কেটে আনবে গাছ থেকে, সে ডাল ভাত রান্না করবে। রান্না করতে সে ঠিক জানে না। সুবল তাকে ঠিক শিখিয়ে নেবে। সে যা জানে না সুবলের কাছে জেনে নেবে। বিকেল হলে সে এবং সুবল যাবে নদীতে। কোনও মানুষজন না থাকলে নদীর অতলে ডুবে ডুবে লুকোচুরি খেলতে তার ভীষণ ভালো লাগবে।