—বেশ বলছ?
—এমন একটা জ্যামের ভিতর থেকে বেশ কায়দা করে গাড়িটা বের করে দিলে।
—তাহলে আমি একা একা চালাতে পারব বলছ?
—সে তো কবে থেকে তুমি চালাতে পারো।
—তবে মা দিচ্ছে না কেন?
—মাসিমার ভীষণ ভয়।
টুকুনের বলতে ইচ্ছা হল ভয় না হাতি। মা একা ছেড়ে দিচ্ছেন না, পাশে সেই যে যুবক বড় হচ্ছে ফুলের উপত্যকায়, সেখানে সে না চলে যায়। মা টের পেলে বলেছিল একদিন, টুকুন এটা তোমাকে মানায় না।
টুকুন যেন বুঝতে পারছে না, এমনভাবে বলেছিল, কী মানায় না মা?
—তুমি তা ভালো করেই বোঝ।
টুকুনের মনে হল, সেটা সে আজও ঠিক বোঝে না। সে আসত পালিয়ে পালিয়ে। পাঁচিল টপকে আসত। তার এমন নিত্য আসার সময় একদিন ধরা পড়ে গেলে—বাড়িতে হইচই। মা, বাবা, সব মানুষেরা ওকে বলেছিল, ছিঃ ছিঃ টুকুন, তুমি কত বড় বংশের মেয়ে।
টুকুনের বলার ইচ্ছা হয়েছিল, সে এলে আমি মা আমার ভিতরে থাকি না। কী সুন্দর এক জগতের সে বাসিন্দা মা। সে তার ফুলের উপত্যকায় নিয়ে যাবে মা, সেখানে গেলে মানুষের বুঝি কোনও দুঃখ থাকে না!
মা বলেছিল, আমাদের দিকটা একবার ভেবো।
সুবল কিছু বলছিল না। সে সত্যি অপরাধ করে ফেলেছে। তার উচিত হয়নি এভাবে। সে কিছুটা মাথা নীচু করে রেখেছিল। কেবল মজুমদার সাহেব পাইপ টানতে টানতে কেমন একটা মজা অনুভব করেছিলেন। এবং সে যে একেবারে ভীষণ কিছু করে ফেলেনি সেটা যেন মজুমদার সাহেব হ্যাঁ বা না—র ভিতর কিছুটা প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি এমনভাবে কথা বলেছিলেন যে, দ্যাখো সুবল, তুমি এভাবে না এসে সদর দিয়ে এলেই পারো। তুমি তো সুবল ফুল বিক্রি করে খাও। তোমার তো মানুষের ভালো দেখাই স্বভাব। তুমি কেন তবে এভাবে আসবে।
সুবলও ভেবেছিল, তা ঠিক, এভাবে না এসে সে সদর দিয়েই আসবে। সে বলেছিল, আমি সদর দিয়েই তবে আসব।
টুকুনের মার চোখ মুখ ভীষণ খারাপ দেখাচ্ছে। কী নির্লজ্জ বেহায়া। দ্যাখো। মান অপমান বোধটুকুও নেই। টুকুনের মা কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবে এতদিন নচ্ছার ছোঁড়াটা এভাবে পালিয়ে এসে কীনা করেছে। সে বলল, তুমি আসবে না। এলে তোমাকে পুলিশে দেব।
টুকুন বলল, পুলিশে দেবে কেন মা? সে চোর না মিথ্যাবাদী।
—দেখছো মেয়ের সাহস। বলেই টুকুনের মা ভীষণ জেদি মেয়ের মতো দুপদাপ কিছুদূর গিয়েই আবার ফিরে এল। এবং মজুমদার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, সব তোমার আসকারাতে। তুমিই এজন্য দায়ী।
—রাগ করছ কেন? ব্যাপারটা একবার ভেবে দ্যাখো না।
—ভাববার কী আছে! তুমি বরং ভাবো। তোমাদের যা খুশি করবে। আমি কিচ্ছু বলব না। এতবড় বাড়ি, তুমি এতবড় মানুষ, তার মেয়ে এমন হলে মান সম্মান আমাদের থাকবে!
আর তখনই মজুমদার সাহেব দেখলেন, পার্লারে বেশ লোকজন জমে গেছে। সদর থেকে দারোয়ান হাজির। আমলা কর্মচারীরা হাজির। তিনি বললেন আপনারা যান। এবং এই যান বলতেই যান—একেবারের কথাতেই কেমন নাটকের কুশীলবের মতো যবনিকার অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন মাত্র আছেন, তিনি টুকুনের মা, টুকুন আর সুবল। মজুমদার সাহেব বললেন, সুবল বোস। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের সুবলের চোখ দুটো ভারী সুন্দর।
টুকুন বলল, ওর মুখটাও ভারী সুন্দর। আর সুবল কী লম্বা, না বাবা।
সুবল এসব বুঝতে পারছে না। ওর চেহারার প্রশংসা হচ্ছে। সে সাদা পায়জামা পরছে। ঝোলা গেরুয়া পাঞ্জাবি। সে রঙবেরঙের ব্যাগ রেখেছে বগলে। ভিতরে নানা বর্ণের ফুল। এবং আশ্চর্য গন্ধের ফুল। এই ঘরে এমন ফুলের সৌরভ যে বেশিক্ষণ রাগ নিয়ে বসে থাকা যায় না। ফুলের সৌরভে মন প্রসন্ন হয়ে যায়। এবং সবারই মন যখন প্রসন্ন হয়ে যাচ্ছিল, বাড়ির সবারই অর্থাৎ দাসীবাঁদিদের পর্যন্ত তখনও কিনা টুকুনের মা ভীষণ অপ্রসন্ন। সেই ছোঁড়া তিন চার বছর যেতে না যেতে কী হয়ে গেল। ট্রেনের সুবল আর এ সুবল একেবারে আলাদা মানুষ। আর বেশ জালটি পেতেছে। অসুখ ভালো করার নামে সেই যে ছারপোকার মতো লেগে থাকল আর যাবার নাম নেই। সে বলল, বাপু তুমি এখানে আসবে না। আমি সোজা কথার মানুষ, সোজা ভাবে বুঝি। টুকুন এখন বড় হয়েছে। সুবলও যে বড় হয়েছে। সুবলও যে বড় হয়েছে সেটা বলল না।—খুব খারাপ এভাবে আসা।
—আর আসব না। সুবল এমন বলে উঠতে চাইলে, মজুমদার সাহেব লক্ষ্য করলেন টুকুনের চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
তিনি কী বুঝতে পেরে বললেন, না না, তুমি আসবে বৈকি।
টুকুনের মুখ চোখ ফের এটুকু বলে লক্ষ্য করতেই বুঝলেন, যে রক্তশূন্যতা সহসা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, এ কথার পর তা আবার কেমন স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি এবার বললেন, রোজ আসবে না। ওর তো এখন অনেক কাজ। পড়াশোনাটা আবার আরম্ভ করতে হচ্ছে। সকালে ইন্দ্র গাড়ি চালানো শেখায়। বুধবার সন্ধ্যায় টুকুন ক্লাবে সাঁতার শিখতে যায়। সোমবার রাতে গিটার বাজনা শিখছে। সুতরাং বুঝতেই পারছ খুব ব্যস্ত টুকুন। টুকুনের ভালো তো তুমি চাও। তুমি বরং এক কাজ করবে। রবিবার বিকেলে তুমি আসবে। টুকুন সেদিন ফ্রি থাকার চেষ্টা করবে। কী বলিস টুকুন!
এসব শুনে টুকুনের মা কী যে করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মানুষটা যে দিন দিন কী হয়ে যাচ্ছে! কোথাকার কে একটা ছেলে—তাকে মুখের ওপর বলতে পারছে না, না তুমি আসবে না। কী অসহায় চোখ মুখ মানুষটার। টুকুনের মার এসব ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন গরম হয়ে যাচ্ছে। ওর নিজের হাত পা কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মেয়েটাকে এভাবে একটা অপোগণ্ড মানুষের সঙ্গে ছেড়ে দিচ্ছে! মান সম্ভ্রম বলে কিছু নেই আর কী আশ্চর্য মানুষটা সুবলের সঙ্গে কথা বলছে ঠিক সমকক্ষ মানুষের মতো।—তুমি সুবল এখন কী করছ? আহা ঢং! সে নিজের কাপড়ের আঁচল অস্থির হয়ে একবার আঙুলে জড়াচ্ছে আবার খুলছে। ওপরে সিলিংফ্যানটা পর্যন্ত তাকে ঠান্ডা করতে পারছে না। ঘড়িতে সাতটা বাজে। চারপাশে নানারকম আলো জ্বলছে। দেয়ালে সব বিচিত্র ছবি। নানা রঙের ছবি। কোথাও বাঘ হরিণের পেছনে ছুটছে। কোথাও শিকারি, টুপি খুলে গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছে, আবার কোনও ছবিতে সূর্যের রং চড়া। আর সূর্য ওঠার নাম নেই অথচ একদল রাজহাঁস জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। এবং ঝাড়লণ্ঠনে একটা চড়ুই পাখি, আলো—আঁধারের খেলায় এসময় বেশ মেতে গেছে। ঠিক নীচে জেরার মুখে সুবল।