সেও বসে থাকে চাচার সঙ্গে। সামনের জমিটা বেলফুলের। হেমন্তের শেষাশেষি এটা। শীতকাল আবার আসবে। এখন সাদা জ্যোৎস্নায় শীতটা ওদের বেশ লাগছিল। একটা পাতলা কাঁথা বুড়োর গায়ে দিয়েছে সুবল। এমন জবুথবু হয়ে বুড়ো মানুষটা এখন ফুলের সৌরভ নিচ্ছে।
এমন দেখলেই সুবলের বলতে ইচ্ছা হয়, চাচা তুমিতো অনেক জানো, এখানে কোথায় বাওবাব গাছ পাওয়া যায় বলতে পার?
অনেকক্ষণ পর বুড়ো মানুষটা সুবলের দিকে তাকায়।—কীরে আমাকে কিছু বলছিস!
—একটা বাওবাবের চারা না হলে যে চলছে না।
—এটা এখানে পাবি কোথায়? সেতো ছোট্ট রাজপুত্রের দেশের গাছ।
এমনি হয়, কারণ ওদের কথা কিছুই সংগোপনে থাকে না। সুবল যেসব গল্প টুকুনের কাছে শুনে আসত, সব এসে হুবহু বুড়ো মানুষটাকে বলত। ইদানীং তো সুবলের সন্ধ্যার পর কথা বলার আর কেউ থাকে না। কেবল বুড়ো মানুষটার সঙ্গে যত কথা। সে উনুনে মাটির হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধর সময় অথবা যখন ডাল সেদ্ধ হয় উনুনে এবং আগুনের তাপে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়—তখন নিবিষ্ট মনে যত রাজ্যের গল্প সে চাচার সঙ্গে জুড়ে দেয়।
—ছোট্ট রাজপুত্রের দেশে যদি আগ্নেয়গিরি থাকে, যদি নদী থাকে, এবং সমুদ্র থাকে তবে আমাদের পৃথিবীতে একটা বাওবাব থাকবে না।
—তা বটে। বলে কেমন একটা হাই তুলল।
—তোমার ঘুম পাচ্ছে চাচা। এবারে ওঠো।
—তোর ঘরে শুয়ে থাকতে এখন ভালো লাগবে।
—খুব।
—তুই তবে মানুষ না।
—তা যা খুশি বলতে পারো।
কেমন আসমান, তারা, চাঁদ, আর দ্যাখ যেদিকে চোখ যায় তোর মনে হবে একটা ফুলের জগতে বসে আছিস। দূরের জ্যোৎস্নায় কেমন ফুলের সৌরভ ভেসে যাচ্ছে দ্যাখ।
বুড়োরা এমন ধরনের কথা বলেই থাকে। সুবল সেজন্য মনে কিছু করে না। কেবল মাঝে মাঝে কথায় সায় দিয়ে যায়। এবং কথা না থাকলে টুকুনের কথা ঘুরে ফিরে আসে।
—জানো চাচা, টুকুন দিদিমণি এখন গাড়ি চালাতে শিখছে।
—টুকুনের জন্য তোর খুব কষ্ট সুবল। কারও জন্য কোনও কষ্ট মনে মনে পুষে রাখবি না। তবে দুঃখ পাবি।
—তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বলে এমন কথা বলছ।
বুড়ো হলে মানুষ অনেক কিছু বুঝতে পারে সুবল।
সুবল এবার বলল আমার কোনও কষ্ট নেই। আমি গাঁ থেকে এসেছি। জলের জন্যে এসেছিলাম। এখন ফুল বেচে খাই! তুমি আছো, এমন একটা ফুলের উপত্যকা আছে আর কিছুদূর গেলে নদী, তার পাড়ে বন আছে, আমার দুঃখ কী চাচা।
—তোর কথা শুনলে আমি সব বুঝি। তোর কতটা কষ্ট আমি ধরতে পারি।
ওরা এভাবে কখনও সকাল করে দেয়। এবং যখন ফুলের দালালেরা আসে, সুবল ফুল তুলে দেয় তাদের। তারপর খুব তাড়াতাড়ি বুড়ো মানুষকে খাইয়ে এবং নামাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে সুবল চলে যায় নদীতে। সে নদীর পাড়ে সব ছেড়ে জলে নেমে যায়। তার এভাবে নদীর জলে সাঁতার কাটতে ভীষণ ভালো লাগে। ও—পাশে বন, বনে নানারকম গাছ, সে সব গাছের নাম জানে না, বুড়ো মানুষটা জানে। সে আগে মাঝে মাঝে বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে বনে আগুন জ্বালতে গেলে কখনও কখনও সে কিছু গাছের নাম জেনে নিয়েছে। বাকিগুলো জানা যায়নি। জানতে জানতে কখন বুড়ো মানুষটা চোখে কম দেখতে থাকল। তাকে আর রোজ নিয়ে সে নদীর ওপারে যেতে পারত না। তাকে একা একা বনের শুকনো পাতা ঘাস কুড়িয়ে আনতে হত সারের জন্য। এবং এই সার তৈরি করা সে বুড়োর কাছেই জেনেছে। তিনি বলেছেন, তোমায় এই দুনিয়াতে আল্লা সব দিয়ে দিয়েছেন, তুমি বাপু করে কম্মে খাও। এমন কিছু নেই যা সংসারে অবহেলার। গাছ তার অতিরিক্ত সব কিছু অর্থাৎ পাতা ডাল, সময় হলে পরিত্যাগ করে, তুমি তা থেকেই অমূল্য সব বস্তু নির্মাণ করে নিতে পারো। বুড়ো মানুষটা আল্লার কথায় এলেই কেমন সাধুভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে।
সুতরাং সাঁতার কাটতে কাটতে সে কখনও নদীর ওপারে ওঠে, বনে ঢুকে যায়। বনে কোনও মানুষের ছায়া থাকে না। বড় শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের পর ট্রেনে এলে, এবং একটা বড় মাঠ পার হয়ে গেলে এমন একটা নদী, এমন একটা ফুলের উপত্যকা, এমন একটা ছোট্ট বন, সবুজ লতাপাতা ঘাস নিয়ে ক্রমে ঈশ্বরের পৃথিবীতে বড় হচ্ছে টের পাওয়া যায় না।
সুবল বেশ হেঁটে যাচ্ছিল। একা এই বনের ভিতর একজন আদিম মানুষের মতো তার হেঁটে যেতে ভালো লাগছিল। সেই যে সে মুসার গল্প শুনেছে, সেই যে সে আদম ইভের গল্প শুনেছে, অর্থাৎ প্রাচীনকালে মানুষ বনে পাহাড়ে থাকত অথবা প্রথম মানুষ আদম—ইভের জ্ঞানবৃক্ষের ফল চুরি করে খাওয়া সব তার একসঙ্গে মনে পড়ছে। এবং মনে হয় সে বেশ ছিল, ভালো ছিল, যেন সে ট্রেনে চড়ে শহরে চলে এসেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলেছে। কেমন তার উচ্চাশা, এবং আকাঙ্ক্ষা তাকে নিরন্তর ভিতরে ভিতরে খুব ছোট করে দিচ্ছে। এমন মনে হলেই চুপচাপ একটা গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টুকুনদিদিমণির কথা মনে হয়। দিদিমণির সেই রুগণ মুখ, বিবর্ণ ছবি চোখে ভেসে ওঠে—তারপর সে কী করে যে আশ্চর্য এক পাখির খেলা দেখিয়ে দিদিমণিকে নিরাময় করে তোলার সময় তার জানা ছিল না, এক আশ্চর্য জাদুকরের খেলায় সে দিদিমণির ভিতরে ভালোবাসা সঞ্চার করেছে। পৃথিবীতে বুড়ো মানুষটাই কেবলমাত্র তার কষ্টটা বুঝতে পারে। সে যে নিশিদিন ফুল ফুটিয়ে বেড়ায় কেউ জানে না দুঃখটা কোথায়। টুকুন দিদিমণির সঙ্গে এখন সে একা একা কথা বলতে পারে। সে সেজন্য এখন বনে ঢুকে গেলে দেখতে পায় যেন সে ছোট্ট রাজপুত্র হয়ে গেছে। একটা বাওবাবের নীচে সে আর টুকুনদিদিমণি দাঁড়িয়ে। বুড়ো মানুষটা যাচ্ছে হেঁটে! ফুলের সৌরভ তখন কেবল ভেসে আসছিল। বুড়ো মানুষটা তখন লাঠি তুলে যেন বলছে, সুবল তোর ঈশ্বর তোকে অহঙ্কার দিক, তুই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে শেখ। ঈশ্বরের পৃথিবীতে ভালোবাসার দাম সবচেয়ে বেশি। তাকে হেলা ফেলা করতে নেই।
সতের
ইন্দ্র বলল, বেশ হাত দেখছি।