—যা। একটু থেমে বলে সুবল তোদের টাকাপয়সা দিয়েছে?
—দিয়েছে চাচা।
—আমাদের জন্য দু জোড়া কলাপাতা কেটে রেখে যাস। নিত্য এটা কেমন বলার স্বভাব মানুষটার।
ওরা বলল, সুবল বলেছে কেটে রাখবে। আমাদের কাজ সারতে সারতে একটু দেরি হয়ে গেল চাচা।
—ও কী করছে?
—আসছে। নলচিতা গাছের দুটো বেড়া কার গোরু ভেঙে দিয়ে গেছে। আজ সারাদিন আমরা ওটাই করলাম। ও ঘুরে ঘুরে দেখছে আরও কোথাও এমন হয়েছে কী না!
—আমাকে ও আজকাল কিছু বলে না।
—বললে তুমি কষ্ট পাবে।
—আমি কষ্ট পাব কেন?
—তোমার এমন সুন্দর বাগান কেউ নষ্ট করলে কষ্ট পাবে না?
—সে তো শুনছি খুব চাষবাস বাড়াচ্ছে।
—ওর জন্য আমাদের এখন আর শহরে যেতে হয় না চাচা। সুবল আমাদের শহরের চেয়ে বেশি পয়সা দিচ্ছি।
এমন বললেই বুড়ো মানুষের যা হয়—সেই ঈশ্বরপ্রীতির কথা, অর্থাৎ আল্লা আমাদের খুব সরল। তিনি পৃথিবীতে চান সরল এবং ভালো মানুষেরা বাঁচুক। তারপরই তিনি সেই মহামহিমের জন্য কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখেন, যেন বুঝতে পারেন, আছেন, চারপাশেই আছেন তিনি। সব লতাপাতার ভিতর ফুলফলের ভিতর, এবং সব গ্রহনক্ষত্র আর সৌরলোক, যা কিছু আছে চারপাশে—তিনি আছেন। কোনও উপাস্য নেই তিনি ভিন্ন। তিনি রাজার রাজা। তিনি সবচেয়ে প্রাজ্ঞ। যা কিছু আছে আকাশে, আর যা কিছু আছে পৃথিবীতে সব তাঁর। তিনি জানেন সব কিছু—সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তাঁর অন্তর্লোকের রহস্য। তিনিই জানেন একমাত্র কী আছে সামনে আর কী আছে পিছনে। তাঁর আসন আকাশ আর পৃথিবীর ওপরে বিস্তৃত আর এই দুইয়ের তিনি নিশিদিন রক্ষাকারী। তিনি তার জন্য এতটুকু ক্লান্ত বোধ করেন না। আর সেজন্য তিনি মহীয়ান, মহামহিম।
সুবল তখন এসে বলল, চাচা তুমি খাবে।
মানুষটার চোখমুখ কেমন উদাসীন দেখায় তখন। চুপচাপ বসে থাকে। খাবার কথা সে ভুলে যায়। তাকে যে খেয়ে নামাজ পড়তে হবে সে যেন তা আর মনে রাখতে পারে না। সেই থেকে, অর্থাৎ সেই যখন পরিশ্রমী মানুষেরা চলে গেল, এবং সে বসে থাকল একা মাদুরে—তারপর সুবলের ফুলের চাষবাস দেখে ফেরা, এবং এসব কেমন যেন তার উদাসীনতার ভিতর পার হয়ে গেছে। সে যে উত্তাপ নেবার জন্য উনুনের পাশে বসেছিল, সেও কিছুটা বোধহয় সেই অন্তর্যামীর ইচ্ছা, সে যে খিদে লেগেছে বলেছে, সেও বোধহয় তাঁর ইচ্ছা। এবং এই বুড়ো মানুষের যা স্বভাব খেতে খেতে কেমন আনমনে হয়ে বসে থাকা তাও।
সুবলেরও স্বভাব হয়ে গেছে, খাও চাচা। তোমার মাছ বেছে দিচ্ছি। এই বলে সে বেশ ডেলার উপর মাছ রেখে দিলে হাত টিপে টের পায় মানুষটা—সুবল বড় যত্নে সব কিছু করে যাচ্ছে।
সে তখন বলবে, সুবল তুই তোর ধর্ম মানিস?
—ঠিক বুঝি না চাচা। ধর্মের কথা মনে হলেই সেই জনার্দন চক্রবর্তীর কথা মনে হত। আর আমাদের ছিল সুবচনি দেবীর মন্দির। ওর ভীষণ বিশ্বাস ছিল, দেবীর ক্রোধে আমাদের দেশটায় খরা এসে গেল।
বুড়ো মানুষটা বলল, তোরা সবাই চলে এলি, সে থেকে গেল।
—ওর ছিল প্রচণ্ড অহঙ্কার। ও ছিল ঠিক তোমাদের মুসার মতো।
রাতে যখন ওরা শোয়, ঘরের দু—পাশে দুটো বাঁশের মাচান, মাচানে নকশি কাঁথার বিছানা, তার পাশে ফুল, বেলফুল, রজনিগন্ধা অথবা গন্ধরাজ ফুল এবং কখনও সব নীল অপরাজিতা, জবা ফুল, চামেলি, চাঁপা কত যে ফুল নিয়ে বেঁচে আছে এই উপত্যকা আর তার ভিতর আছে একটা লাল টালির ঘর, সেখানে সুবল আর চাচা শুয়ে যতক্ষণ ঘুম না আসে কেবল নানারকম গল্প করে যাওয়া। বুড়ো মানুষটা খুব বেশি মুসার গল্প বলতে ভালোবাসত। সেই থেকে সুবল একটা মানুষের সঙ্গে কেবল জনার্দন চক্রবর্তীর মিল পায়, তার নাম মুসা। মুসার মতো আত্মবিশ্বাস ছিল মানুষটার। কেবল লাঠিটা ছিল না হাতে। অথবা যে লাঠি ছিল, সেটা বুঝি ঈশ্বরপ্রদত্ত ছিল না। না হলে মুসা সেই যে তাঁর লোকদের জন্য জল চাইলেন, আর তখনই দৈববাণী, তোমার আসা (লাঠি) দিয়ে পাথরে মারো। সেই মুসা তার লাঠি দিয়ে পাথরের পর পাথর ছুঁয়ে গেল, আশ্চর্য, নীল পর্বতমালার নীচে, শুকনো মরুভূমিতে বারোটি জলের প্রস্রবণ। জল পান করো মনুষ্যগণ। আল্লাহ যে জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে খাও আর পান করো! অন্যায়কারী হয়ে দেশে অপবিত্র আচরণ করো না।
যখন সেই উপত্যকায় সাদা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে থাকত, আর ফুলেরা ফুটতে থাকত, এবং সব ফুলেদের ফোটার ভিতর আশ্চর্য উল্লাস থাকত, বুড়ো মানুষটা শুয়ে শুয়ে তা টের পেত। সে বলত, সুবল আমাকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবি। আমাকে একটু গোলাপের বাগানে নিয়ে যাবি। অথবা চামেলি গাছটার নীচে তুই আর আমি কিছুক্ষণ বসে থাকব।
ছেলেমানুষ সুবল। সারাদিন খাটাখাটনি করে তার ঘুম পায়। সে এখন সপ্তাহান্তে যায় বড় শহরে। টুকুন এখন কত বড় আর লম্বা হয়েছে। সে যায় সদর দরজা দিয়ে। টুকুন আরও সুন্দর করে সাজে তখন। এবং যে দিনটাতে সে শুনেছে ইন্দ্র আসে না। টুকুনের ভয় কেন যে ইন্দ্রকে নিয়ে। সেতো কোনও পাপ কাজ করেনি। টুকুনদিদিমণির মুখ চোখ, এবং যখন সেই পিয়ানোতে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে চোখ বুজে গান গায়, ওর ববকরা চুল ঘাড়ে রেশমের মতো উড়তে থাকে তখন সে কেমন এক আশ্চর্য সুষমা টের পায় টুকুনের শরীরে। ঈশ্বর টুকুনকে যেন এতদিন অপবিত্র করে রেখেছিল। টুকুনের শরীর দেখে অর্থাৎ টুকুনের সব কিছু মা হবার জন্য যখন উন্মুখ, টুকুনকে কী করে আর ঈশ্বর অপবিত্র রাখেন। পবিত্র মুখে সুবলের জন্য ভীষণ মায়া। সুবলও যখন আসে বেশ সুন্দর পোশাকে আসে। সে তার ঘাড়ে একটা রঙবেরঙের ব্যাগ রাখে। ব্যাগে থাকে যাবতীয় সব কেয়াফুল। সুবল এলেই সব মানুষেরা টের পায় সুন্দর সুগন্ধে গোটা বাড়িটা ম ম করছে। অথচ কেউ টের পায় না, একজন মানুষ গ্রাম থেকে চলে আসছে, সদর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, ঘোরানো সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে, এবং এ সময় টুকুন ঠিক থাকবে। অন্য দিকের দরজা ঠিক বন্ধ থাকবে—কিন্তু রোজ এখন এটা করতে পারে না। টুকুন ভালো হয়ে গেছে বলে তাকে ইন্দ্রের কাছে গাড়ি চালানো শিখতে হয়। ভালো হয়ে গেছে বলে আত্মীয়স্বজনেরা, বন্ধুবান্ধবেরা তাকে ঘিরে থাকতে ভালোবাসে। অথচ সুবল টের পায়—বড় অস্বস্তি টুকুনের। সে যখন যা ভাবছে, একটা বাওবাব গাছের চারা পেলেই টুকুনদিদিমণিকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে। এবং এতসব ভাবনায় সে রাতে বড় ক্লান্ত থাকে। ওর ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু বুড়ো মানুষটা টের পেয়েছে ফুলেরা ফুটছে। সে সাদা জ্যোৎস্নায় বসে চুপি চুপি ফুলেদের ফুটতে দেখবে। এবং মনে হয় যে তখন মহামহিম আলাহর করুণা সব ফুলে ফুলে আশ্চর্যভাবে টের পায়। বুড়ো মানুষটা চুপচাপ তখন, কেবল গাছের নীচে বসে থাকতে ভালোবাসে।