বুড়ো মানুষটা চলাফেরা তেমন আজকাল করতে পারে না বলে, সে তার জন্য আর বুড়ো মানুষটার জন্য রান্না করে। নামাজের সময় হলে সে মনে করিয়ে দেয়—এখন তোমার কর্তা জহোরের নামাজ। বুড়ো মানুষটা চোখে আজকাল ভালো দেখতে পায় না। কোথাকার কে সুবল এসে এখন এই ফুলের উপত্যকায় রাজা হয়ে গেল প্রায়। সে সুবলকে সব দিয়ে যাচ্ছে। কারণ বুড়ো মানুষটার তো কেউ নেই। সে সুবলকে সব দিয়ে যেতে পেরেছে বলে ভীষণ খুশি। এমনভাবে সে হালকা হতে পারবে কখনও ভাবতেই পারেনি। বড় চিন্তা ছিল তার, এমন সুন্দর একটা ফুলের উপত্যকা কাকে দিয়ে যাবে, ওর তো কেউ নেই। যারা আছে তারা সব ফুলের দালাল। কী লোভ বেটাদের। এসেই একটা বড় রকমের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলত—তা মিঞা, তুমি এমন একটা কাজ করলে কী করে!
—কী করে আবার, পরিশ্রম করে?
—শুধু পরিশ্রমে হয়?
—কেন হবে না?
—হয় না মিঞা।
তারপর সে থেমে একটু কী ভাবত, তারপর বলত, হ্যাঁ আর আছে অহঙ্কার। আমার হাতের অহঙ্কার। আল্লা আমার সঙ্গে আমার অহঙ্কারের জন্ম দিয়েছেন।
সে ঠিক ঠিক বুঝতে না পারলে বুড়ো মানুষটা বলত, আমি চাই আমার মতো এমন ফুলের চাষ কেউ আর করতে পারবে না। দিনমান খেটে, রাতে নদী থেকে জল এনে, রাতে কখনও বনে পাহাড়ের সব পাতা পুড়িয়ে এমন সব সার তৈরি করতাম—ভেবে অবাক হবে, সে সার না দিলে—ফুল কখনও এমন বড় হয় না। একটু থেমে সে ফুলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। তারপর বলত, আমি চাই না দুনিয়ায় আমার চেয়ে কেউ বেশি ফুলের চাষ ভালো জানুক।
সুবলের সঙ্গে সুখে দুঃখে ইমানদার মানুষটা এমন বলত।—আমার একটা লোভই আছে সুবল, কেবল জমি কিনে ফুলের চাষ বাড়িয়ে যাওয়া।
বুড়ো লোকটা আরও সব গল্প করত ওর সঙ্গে। সে ফিরে যখন বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে রাতের আহার তৈরি করত—তখন বুড়ো মানুষটার গল্প আরম্ভ হত। কারণ সে চোখে দেখতে পায় না বলে, রাজ্যের সব গল্প মনে করতে পারে। সুবলকে সে সব দিয়ে দেবার পরই কেমন আরও বেশি বুড়ো হয়ে গেল। সুবল যাদের নিয়ে চাষবাস বাড়াচ্ছে তাদের সন্ধ্যা হলেই ছুটি দিয়ে দেয় বলে, জায়গাটা কেমন আরও বেশি নির্জন হয়ে যায়। নদীতে কখনও নৌকার লগির শব্দ কানে আসে। বৈঠা মেরে কেউ হয়তো গান গেয়ে চলে যায়। আর সূর্যাস্ত হলে যখন হাত—পা ধোবার জল এনে দেয় টিউকল থেকে, বুড়ো মানুষটা কেমন আন্দাজে গল্প আরম্ভ করে দেয়। নীচে যেসব ঘাসের চটান আছে তার একপাশে সুবল রান্না আরম্ভ করে দেয়। সোজা রান্না। নদী থেকে মাছ আসে। বুড়ো মানুষটা চাপিলা মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। বিকেলে সেই মানুষটা এসে বেশ কয়েকটা বড় মাছ রেখে দিলে আন্দাজে হাত দিয়ে টের পায় মাছগুলো খেতে খুব ভালো লাগবে।
বুড়ো মানুষটার সামনে একটা হ্যারিকেন জ্বালা থাকে। মাদুরে সে বসে থাকে। পা দুটো তার ভাঁজ করা। মাথায় সাদা কাপড়ের টুপি। নানারকমের কারুকাজ টুপিতে। খুব সূক্ষ্ম সুতোর কাজ। সুবল ওর লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টুপি রোজ ধুয়ে রাখে। খুব সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার শখ এই মানুষটার, যেমন সে ভাবে এই সরল পৃথিবীতে আল্লা অথবা ভগবান যেই হোক না সব কিছু রেখে দিয়েছেন মানুষের জন্য। মানুষ সেটা পরিশ্রম করে পাবে। ওর খুব ভাবতে কষ্ট হয়, সে কিছু এখন আর করতে পারে না। কাজ না করলে ঈশ্বর চিন্তা হয়। মাঝে মাঝে সে যখন এমন ভাবে তখন তার হাই ওঠে। সুবলের মাছের ঝোল টগবগ করে ফুটছে। সে সুন্দর কালোজিরে সম্ভারে বেগুন দিয়ে জিরে লংকার কেমন সব সুস্বাদু খাবার করে। অথবা সে যখন মাছ সাতলায় তার ঝাঁঝ নাকে লাগলে বেশ খিদেটা বেড়ে যায়। তখন আর বুড়ো মানুষটা বসে থাকতে পারে না। সে বারান্দা থেকে নেমে সুবলের কাছে চলে গেলে, মনে হয় বেশ একটা নির্জন পৃথিবীতে তারা বেঁচে আছে। অনেক দূরান্তে বন থেকে কিছু জীবজন্তুর ডাক, অথবা পাখপাখালির আওয়াজ এবং সে চুপ করে থাকলে পৃথিবীর যাবতীয় কীটপতঙ্গের আওয়াজ টের পায়। সে তখন চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কিছুটা যেন গল্প করে সময় পার করে দেওয়া অথবা গল্প করে খিদের কথা ভুলে থাকা। তাই ওর গল্পে এমন সব কথা থাকে—বুঝলি, আল্লা আমাদের খুব সরল।
সুবলের স্বভাব অন্য রকমের।—তুমি আবার কেন চাচা বাইরে এলে। ঠান্ডা না লাগালে বুঝি চলে না। সুবলের মাঝে মাঝে শখ হলে বুড়ো মানুষটাকে চাচা বলে ডাকে। এমন একটা ডাক খোঁজ সে চায়! সে ভালোবাসে সুবল তাকে চাচা বলে ডাকুক।
সে উনুনের পারে বসে কেমন কিছুটা তাপ নেবার মতো হাত বাড়িয়ে বলল, তোর উনুনের আঁচটা ভালো লাগছে। তারপর কেমন যেন সরল মানুষের মতো বলা, আমার খুব খিদে লেগেছে সুবল। তুই আমাকে খেতে দে। তোর কেবল কাজ আর কাজ।
—তুমি না বললে চাচা, আল্লা মানুষের জন্য পৃথিবীতে সব কিছু রেখে দিয়েছেন। পরিশ্রম করে তাকে সেটা পেতে হবে।
—খিদে লাগলে সব ভুলে যাই।
—আমি তো তোমার জন্য তাড়াতাড়ি করছি। সারাদিন পর দুটো খাবে—
—আমি কাঠ ঠেলে দিচ্ছি। তুই যা! কলাপাতা কেটে আন।
—রাতে কেউ গাছ থেকে পাতা কাটে!
—ওরা যে বলল, তুই কেটে রাখিসনি।
ওরা মানে যারা কাজ করে। কাজের শেষে ফিরে যাবার সময় বুড়ো মানুষটার কাছে এসে ওরা দাঁড়ায়। বলে, চাচা যাচ্ছি।