—তুমি চান করে নেবে?
—তোমার চানের ঘরটায় কী সুন্দর গন্ধ। মারবেল পাথরে কারুকাজ করা সব পাথরের দেয়াল—কী মসৃণ! সুবল দেয়ালের গায়ে হাত দিয়ে কী যেন দেখছে। ভীষণ মসৃণ। হাত পিছলে পিছলে যাচ্ছে। নানারকম গন্ধ সাবান। তেল। শ্যামপু সব। এসব সে ঠিক চেনে না, কী দিয়ে কী হয়, এবং মনে হয় সুবলের শরীরে ঘামের গন্ধ। টুকুন সুবলকে হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমে নিয়ে এসেছিল। যা খাবার আছে সে সুবলকে খেতে দেবে। কিন্তু এখানে এসে সুবলের যে কী হয়ে গেল—সে চান না করে খাচ্ছে না। সে খুব পরিশ্রম করে—তার চোখে—মুখে আশ্চর্য দৃঢ়তা। টুকুন এসব দেখে ভাবল, চান করে নিলে তাকে আরও বেশি তাজা দেখাবে।
টুকুন বলল, সুবল তুমি চান করবে?
—মন্দ হয় না, টুকুন।
টুকুন শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে এভাবে জল পড়বে। বাথরুমের সব বুঝিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চান করে নাও। আমি দাঁড়াচ্ছি। সুবল বলল, টুকুন, আমি দরজা বন্ধ করে দেব।
টুকুন দরজা বন্ধ করার কারণ খুঁজে পেল না। সুবল তো তার কাছে ছোট্ট এক বালক বাদে আর কিছু না। সে তো সেই যেন দুই শিশু নদীর পারে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কোনও জামাকাপড় নেই। কেবল ওরা ছুটছে।
টুকুন বলল, আমাকে তোমার লজ্জা কী?
সুবল বুঝতে পারল টুকুনদিদিমণি এখনও স্বাভাবিক নয়। সে বাথরুমের দরজাটা খোলাই রাখল। সে একটা তোয়ালে পরে নিয়ে জামা পাজামা পাশের ব্রাকেটে ঝুলিয়ে রাখল।
টুকুন বেশ মনোরম চোখে দেখছে। সুবলের কী সুন্দর হাত। পুষ্ট বাহু। এবং পিঠের শক্ত কাঁধ খুব মজবুত। সে শাওয়ারের নীচে বসে গায়ে মাথায় সাবান মাখছে। বস্তুত সুবলেরও একটা অসুখ হয়ে গিয়েছিল—সে খরা অঞ্চল থেকে চলে এসে যখন কলকাতা নগরীতে এত প্রাচুর্য বিশেষ করে জলের—ভাবা যায় না—সে এখনও ফাঁক পেলে যেখানে সেখানে চান করে নেয়। শরীরে ওর কী যে গরম বেঁধেছে কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। সে এখানে এসেও এই লোভ সামলাতে পারেনি।
টুকুন বলল, আমি তোমাকে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছি।
সুবল জানে, টুকুনের কোনও ইচ্ছাকে অবহেলা করতে নেই। টুকুন কত বড়, কত বড় বাড়ির মেয়ে, টুকুন যা বলবে তাকে এখন তাই করতে হবে। সে এভাবেই বুঝে ফেলেছে, এর ভিতর এক নতুন প্রাণের সাড়া দেখা দিচ্ছে। এখন কিছুতেই সেখানে ভাঁটার টান আনলে চলবে না। সে বলল, তুমি টুকুন পারবে?
—বা রে পারব না কেন?
—আমার বিশ্বাস হয় না টুকুন—সেই রাজার ঘোড়ায় চড়ে যাবার কথা মনে আছে? হরিণ ধরতে যাচ্ছে রাজা। হরিণ প্রাণের ভয়ে ছুটছে। রাজা, ঘোড়া পাহাড়ের ওপর দৌড় দিচ্ছে। পাথরে পাথরে ঘসা লেগে ঘোড়ার খুরে আগুন লেগে গেছে।
—সত্যি কী সুন্দর হরিণ না। টুকুন সুবলের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কী সুন্দর মজবুত সুবল। টুকুন বলল, আমিও চান করব। সে বলল, আমাকে সাবানটা দাও। সে একেবারে শিশুর মতো জলের নীচে খেলা করতে থাকল। সুবলও কখন এমন হয়ে গেছে। ওরা দুজনে গল্প করছিল—পাশের ওদিকটার যে দরজা বন্ধ আছে এবং কেউ আর একদিকটায় আসতে পারবে না ওরা জানে।
এবং এভাবে কী হয়ে যায়। সুবল স্নানের সময় শরীর থেকে সব জল শুষে নিতে গিয়ে দেখল, তোয়ালেটা কী করে কখন শরীর থেকে খসে পড়ে গেছে। সে তোয়ালে ব্যবহারের নিয়মকানুন ঠিক জানে না। আর টুকুন ওকে অপলক দেখছে। স্থির। চোখে বিস্ময়। সে টুকুনের এমন চেহারা দেখে একেবারে ফ্রিজ হয়ে গেছে। দুজনেই দুদিকে, একটা ফ্রিজ শটের মতো। সুবলের যেন মুহূর্তের জন্য কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল।
পনের
সুবল চলে যাবার পর গোটা ব্যাপারটা টুকুনের মাথায় কেমন একটা অদ্ভুত নেশা ধরিয়ে দিল। সে ভিতরে ভিতরে ভীষণ একটা অভাবের কথা ধরতে পারছে। সে সংসারে খুব একা—পৃথিবীতে যে মৃত্যু এবং গ্রহাণুতে চলে যাওয়া বাদে অন্য কিছু আছে তার জানা ছিল না। সে এটা যে কী দেখে ফেলল। ওর চোখ বুজে আসছে। সুবল আবার কখন আসবে—শুধু প্রতীক্ষা।
ওর চোখে এখন কিছুটা স্বপ্নের মতো ঘটনাটা ঝুলে আছে। এক আশ্চর্য মহিমাময় শরীর সুবলের। এবং শরীরের সর্বত্র এক কঠিন অবয়ব, কী শক্ত, অথচ ভারী কোমল, লাবণ্যে ভরা, লম্বা সুবল, যার শিশুর মতো সরল মুখ এখন আরও সুন্দর মনে হচ্ছে। সে একটা পুরুষের শরীর, এবং শরীরের সবটা একসঙ্গে এভাবে কখনও দেখতে পায়নি।
ওর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বাবা এঘরে কিছুক্ষণ এসে বসে থেকে গেছেন। নানারকম প্রশ্ন করেছেন। বলেছেন, টুকুন তুমি আমাকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাবে না? ডাক্তারবাবু এসেছেন, তিনিও শুনতে চান।
টুকুন কেবল বলছিল, বাবা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। সে ইচ্ছে করেই হাই তুলছে। বলছে, আমাকে তোমরা আর কষ্ট দিয়ো না।
রাতে গীতামাসি একটা কম আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আলোটার রং কেমন তামাটে। এবং এই আলোটা না জ্বালালে, অন্যদিন টুকুনের ঘুম আসত না। আজ অন্যরকমের। সে গীতামাসিকে বলেছে—সবুজ আলোটা জ্বালিয়ে দেবে?
—সবুজ আলো জ্বাললে তুমি তো ঘুমোতে পারো না।
—তুমি দাও গীতামাসি। তামাটে রং আজ আমার ভালো লাগবে না।
টুকুন গীতামাসিকে আরও বলেছিল, এই দ্যাখো আমার বালিশের নীচে কিছু রজনিগন্ধা আছে। ওগুলো রুপোর ফুলদানিতে রেখে আমার মাথার কাছে রেখে যাও। আমার চারপাশে আরও কিছু রাখো, যাতে আমাকে আরও সুন্দর দেখায়। শেষপর্যন্ত ‘আমাকে সুন্দর দেখায়’ সে বলতে পারেনি। কেমন লজ্জা এসে গেছিল। তার এমন একটা অনুভূতি এতদিন কোথায় যে ছিল! ওর শির শির করছে শরীরটা। এবং চাদর দিয়ে গোটা শরীরটা ঢেকে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে। এটা যে কী হয়ে যাচ্ছে ভিতরে। ওর জল তেষ্টা পাচ্ছে। সে টিপয় থেকে হাতির দাঁতের মিনা—করা জলদানি তুলে জল খেল। তার হাত কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে। ভিতরে কীসের যেন ঝড়। যেন কোথাও বাদলা দিনে সে বৃষ্টি—ভিজে এক বড় মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে। ওর পায়ে সবুজ ঘাসের চিহ্ন। ওর চোখে—মুখে বৃষ্টির ছাট। পরনে সাদা সিল্ক লতাপাতা আঁকা নীল রংয়ের। পায়ে তেমনি আলতা। হাতের আঙুলগুলো লম্বা লম্বা, নখে নীল রংয়ের পালিশ। নখগুলো কিছুটা লম্বা, কিছুটা উজ্জ্বল, সে হাতের ওপর হাত রেখে নিজের সুন্দর হাত পা দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যাচ্ছে। সে আর টুকুন থাকছে না। সে কল্যাণী হয়ে যাচ্ছে। সে কল্যাণী মজুমদার হয়ে যাচ্ছে। সে তার ভালো নামটা অথবা বড় হয়ে যে নামটা ব্যবহার করার কথা, কতদিন পরে মনে করতে পারছে।