আশ্চর্য এক মেলডি ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়িময়।
সুবলেরই প্রথম মনে হল দরজায় কারা আঘাত করছে। সে টুকুনকে ঠেলে দিয়ে বলল, টুকুন কারা দরজায় ধাক্কা মারছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো ব্যাপারটা হয়ে গেল। টুকুন বাজানো বন্ধ করে দিল। সুবল লুকিয়ে পড়ল টুকুনের খাটের নীচে। তারপর খুব সহাস্যে দরজা খুলে দিলে দেখল সবাই, টুকুন দরজা খুলে দিচ্ছে। ওরা হাসবে না কাঁদবে স্থির করতে পারছে না। মা বললে, টুকুন তুমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলে?
—হ্যাঁ মা।
—সত্যি?
—হ্যাঁ মা।
টুকুনের মা টুকুনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। সে বলল, তুমি আর একবার বাজাবে?
—এক্ষুনি?
—তোমার বাবা এলে তাকে বাজিয়ে শোনাও না। তিনি খুব আনন্দ পাবেন।
—বাবা আসুক।
—আমি জানি টুকুন ঠিক একদিন সুস্থ হয়ে যাবে।
গীতামাসি বলল, কোথাকার একটা রাস্তার ছেলেকে ধরে আনতে যাচ্ছিলেন বড়বাবু।
মা বলল, আজকালকার ডাক্তারও হয়েছে তেমন। তারপর কী ভেবে বলল, একবার ইন্দ্রকে ডাকো না?
—সে তো নেই দিদিমণি?
—কোথায় গেল?
—সে তো এসময়ে ক্লাবে রোয়িং করতে যায়। ইন্দ্রকে খুশি রাখার জন্য মা—র যে কী করার ইচ্ছা। কারণ এখানে বসে থাকতে চায় না ইন্দ্র। আজ ইন্দ্র এলে খুব খুশি হবে।
টুকুন এখন চাইছে সবাই চলে যাক। কিন্তু সে যে কেন পিয়ানো বাজাতে গেল। সবাই এখন এটা গল্পগাথার মতো ব্যবহার করবে। ছুটে আসবে। এখন যেভাবে হোক সুবলকে বের করে দিতে হবে। ওর ভিতরে সুবলের জন্য একটা দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে। এবং নানাভাবে সে চিন্তা করছে। কী করলে যে এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সবাই এসে টুকুনকে দেখে যাচ্ছে। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে এখন আবার সাদা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়বে ভাবল। কেবল সুবলের জন্য সে শুয়ে পড়তে পারছে না। খাটের নীচে একবার উঁকি দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ওদিকে কেউ গেলে পা দেখে ফেলবে। এবং এমন একটা ভয়াবহ সমস্যার মোকাবেলা সে জীবনে করেনি। এবং এইসব সমস্যা অথবা তাড়না তাকে এখন বড় বেশি স্বাভাবিক করে রেখেছে। সে বলল, মা আমার আবার ভালো লাগছে না কেন জানি। আমার ঘুম পাচ্ছে।
গীতামাসি, যারা সবাই চাকর এবং অন্যান্য সব পরিজন এসেছিল তাদের চলে যেতে বলল। গীতামাসির কাজ এখন কত বেড়ে গেছে এমন ভাব। সে বলল, দিদিমণি, টুকুন এবার ঠিক বড় হয়ে যাবে।
এ—ছাড়া টুকুনের মার কত সব দুশ্চিন্তা এবং মনের ভিতর সংশয় থেকেই যাচ্ছে। টুকুন এভাবে আরও দু’একবার খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। অবশ্য প্রতিবারই পাখিয়ালা সুবল ছিল কাছে। এবার সে নেই। কিন্তু এমন ম্যাজিকের মতো ব্যাপারটা ঘটবে আশা করতে পারেনি।
মা বলল, টুকুন আমি তোমার জন্য একজন পিয়ানোর শিক্ষক দেব।
টুকুন বলল, আমি শোব মা। আর বসে থাকতে পারছি না।
গীতামাসি টুকুনকে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিচ্ছেন।
মা বলল, এটা কী করছ গীতা?
গীতামাসি বলল, টুকুন আবার আগের টুকুন হয়ে যাচ্ছে।
খাটের নীচে যেই না শুনতে পেল সুবল, টুকুন আবার আগের টুকুন হয়ে যাচ্ছে, সে বোধহয় জোরজার করে উঠেই আসত—কেবল টুকুন চাদরটা একটু ফেলে দিয়ে ওকে একদিকে ভালো করে আড়াল করে দিচ্ছে।
টুকুন শুয়ে পড়লে মা বলল, তুমি যে বলেছিলে, বাবা এলে বাজাবে?
—কাল বাজাব মা। খুব দুর্বল লাগছে।
—তা ঠিক। একদিনে বেশি ভালো না। তুমি বরং একটু শুয়ে থাক। বাবা এলে আমরা আসব।
মা চলে গেলে গীতামাসি বলল, টুকুন এখন তোমার দুধ, আপেল, সন্দেশ খাবার সময়! বের করে দিচ্ছি।
—কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি মাসি দরজাটা ভেজিয়ে দাও না।
দরজা ভেজানোর কথা উঠলেই মাসি উঠে পড়বে। কারণ বারবার এক কথা শুনতে ভালোও লাগে না। নিজের ঘরে গিয়ে বেশ পান—দোক্তা খেয়ে উত্তরের বারান্দায় চলে গেলে, নীচ থেকে যারা উঠে আসে তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করা যায়।
গীতামাসি বলল, কিন্তু এখন তো তোমার এসব খাবার সময়।
টুকুন বুঝতে পারল, না—খাইয়ে ছাড়াবে না। সে বলল, তুমি রেখে যাও, আমি ঠিক খেয়ে নেব।
—অন্যদিন আমার সামনে তুমি খাও। আজ কেন এমন বলছ?
—আজ তোমার সামনে খাব না। কিছুতেই খাব না।
টুকুনের জিদ উঠলে একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। সেজন্য ভয়ে ভয়ে গীতামাসি বাইরে বের হয়ে এলে সে নিজে উঠে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। ডাকল, সুবল বাইরে এসো। ওরা সবাই চলে গেছে।
সুবল বের হয়ে এলে টুকুন বলল, তুমি আমার সঙ্গে এসো।
সুবল বলল, আমার ফুলের থলেটা দেখছি না।
—ওটা আমি ঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছি। তুমি যে কী বোকা না! ওটা দেখলেই ওরা বলত না, এই থলেটা কার, কী করে এমন একটা বিশ্রী থলে এখানে আসতে পারে। দরকার পড়লে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দিত।
সুবল শহরের অনেক ব্যাপার যেমন ঠিক বোঝে না, তেমনি ডিটেকটিভ কথাটাও বুঝতে পারলে না। সে বলল, ডিটেকটিভ কী টুকুন?
—ওরা চোর গুণ্ডা বদমাশ ধরে বেড়ায়। কেউ যদি খুন হয়, কে খুনটা করেছে তাকে খুঁজে বের করে।
—আমার সামান্য থলেটার জন্য এতবড় একটা ব্যাপার তবে ঘটে যেতে পারে?
—সুবল তুমি জানো না, এটা যে কী অসামান্য অপরাধ! আমার মা—র চোখ দেখতে সব টের পাই সুবল।
ওরা বাথরুমে ঢুকলেই সুবল বলল, জল দেখলেই চান করতে ইচ্ছা হয় টুকুন। বাঃ কী মজা! পাতাল থেকে ফোয়ারার মতো জল উঠে আসে, কী মজা প্রথম প্রথম ভাবতাম। খরা অঞ্চল থেকে আসার পর, দিনে কতবার যে রাস্তার কলে চান করতাম।