ট্রেনটা বোধ হয় তখন নদী পার হচ্ছিল, কোনও বড় সেতু পার হচ্ছিল, অথবা বাঁকের মুখে কোনও পাহাড়ের ভিতর ট্রেনটা ঢুকে যাচ্ছে—সুতরাং গম গম, খুব দূর থেকে গম গম শব্দ, মনে হয় খুব দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ, যেন হাওয়ায় ভর করে শব্দটা কানের পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে।
তারপর সেই আলো, ট্রেনের আলো, দূর থেকে ওরা ট্রেনের আলো দেখতে পেল। ট্রেনটা যত দ্রুত এগিয়ে আসছে তত ওদের বুক দুরু দুরু করছিল। তত ওরা মরিয়া হয়ে উঠছে। যেন ওরা কোনও দীর্ঘ মরুভূমি পার হবে এখন—সুতরাং সকলের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই, সকলের রক্তে এক অমানুষিক উত্তাপ সঞ্চিত হচ্ছে।
হাড়গোড় বের করা মানুষগুলোর দিকে এখন আর তাকাচ্ছে না। লাইনের ওপর যেন শত শত কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষদের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, স্নান না করার জন্য চুল শনের মতো হয়ে গেছে, গায়ে খড়ি ওঠা, পেটের ভিতর যন্ত্রণা, ক্ষুধার যন্ত্রণা। সামান্য লঙ্গরখানার দান এই সামান্য পথটুকু অতিক্রম করতেই হজম হয়ে গেছে।
ওরা সকলে আলোটা দেখে ভয় পাচ্ছে। ওরা এই ভয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য কী করবে ভেবে পাছিল না। ওরা অন্ধকারে পরস্পর মুখের দিকে তাকাল। বৃদ্ধ পুরোহিত পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেছে। দৈত্যের মতো ঝড়ের বেগে ট্রেনটা ছুটে আসছে, পাহাড়ের ওপর পড়লে রক্ষা থাকছে না। সব মানুষগুলোর রক্তে এই লাইন ভেসে যাবে, শকুনের আর্তনাদ শোনা যাবে দূরে—বৃদ্ধ ভয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন ডেকে উঠল, জল চাই, আমরা জল চাই।
সঙ্গে সঙ্গে সুবল ওর পাখিটাকে বুকের কাছে এনে বলল, হ্যাঁ, আমরা জল চাই। যুবক—যুবতীরা বলল, জল চাই, জল চাই।
কড়ুই গাছের নীচে থেকে বউ—বিবিরা চিৎকার করে উঠল, জল চাই, জল চাই।
ভূতের ভয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেন ওই মানুষগুলো জল চাই, জল চাই বলে হরি নামের মতো মন্ত্র উচ্চারণ করছে। এই উচ্চারণ কেবল দীর্ঘ মাঠে শব বহনকারী মানুষের কান্নার মতো শোনাচ্ছে। বড় মাঠ সামনে, লাইনের পাশে বড় পাহাড়, শালগাছের মাথায় ভাঙা চাঁদের আবছা অন্ধকার, এতগুলো মানুষের ভয়াবহ কণ্ঠ চারপাশের পরিবেশকে খুব বিষণ্ণ করে তুলছে।
ট্রেনটা হুইসল দিচ্ছে, ড্রাইভার টের পেয়ে গেছে বুঝি। আবছা কী যেন দেখা যাচ্ছে লাইনের ওপর। প্রথম কুয়াশার মতো মনে হচ্ছে, তারপর মনে হচ্ছে মরীচিকার মতো হাজার সরলরেখা পুতুলনাচের দড়িতে ঝুলছে।
ড্রাইভার চোখ মুছে নিল। এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর খরা চলছে, এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত নেই এবং এই অঞ্চলে মহামারী আরম্ভ হয়ে গেছে—ড্রাইভার ভালো করে দেখে নিল। কিছুদিন আগে ড্রাইভার দেখেছে দূরে মাঠে সব মৃত গোরু—বাছুর—মোষ, হাজার হবে প্রায়, লাইনের ধারে ধারে মরে আছে। মাঝে মাঝে সে মৃত মানুষের মুখও দেখেছে। লোকালয়ে আর কোনও লোক নেই, সকলে শহর গঞ্জে চা—বাগানে এবং দূরদেশে চলে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর দুর্দিন মানুষের।
আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা বাঁক নিলে ড্রাইভার টের পেল, শত শত কঙ্কাল যেন রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ভূতের মতো নৃত্য করছে। সে এবার প্রাণপণে রড চেপে ধরল, প্রাণপণে সে হুইসল বাজাতে থাকল। এরা সব মানুষের কঙ্কাল, চোখ—মুখ কোটরাগত, লাইন থেকে একটা প্রাণী সরছে না এবং ড্রাইভার ভূতের ভয়ে প্রথম ভাবল যদি ওরা যথার্থই মানুষের অভুক্ত আত্মা হয় তবে আর ট্রেন থামিয়ে কী হবে, বরং সে জোরে বের হয়ে যাবে, ট্রেন থামালে মৃত আত্মারা ওর ট্রেনটাকে এই নির্জন মাঠে আটকে দিতে পারে। সুতরাং ফের চাকা ঘুরিয়ে দিতে গেল—ফায়ারম্যান শক্ত হাতে বাধা দিল, বলল, না। ওগুলা ভূত নয় দাদা। ওগুলো মানুষ। সে ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনটা থামিয়ে দিল।
মানুষগুলো কোলাহল করতে থাকল, জল চাই, জল চাই। মানুষগুলো কামরায় উঠে গেল। বলল, জল চাই, জল চাই।
ভিতরের যাত্রীরা ভয় পেয়ে গেছে। সব কঙ্কালের মতো মানুষের চেহারা, ক্ষুধার্ত, চোখ কোটরাগত, হাত—পা শীর্ণ, ক্লান্ত এবং অবসন্ন। এই সব মানুষের শরীরে জীর্ণ—বাস, ময়লার জন্য দুর্গন্ধ, ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ, যাত্রীরা সকলে নাকে কাপড় দিচ্ছে। ভয়ে ওরা কথা বলতে পারছে না। যেন শয়তানের প্রতীক এইসব মানুষেরা। যাত্রীদের সুন্দর সুদৃশ্য কামরার প্রাচুর্য ওদের পৈশাচিক করে তুলেছে। ওরা প্রেতের মতো ভিতরে ঢুকে দু’হাত ওপরে তুলে জলের জন্য, জল চাই, বলে নামকীর্তনের মতো নাচতে থাকল।
যাত্রীদের মনে হল, ক্ষুধার্ত সব রাক্ষস অথবা ডাইনির মতো মানুষগুলো আকাশে বাতাসে দুঃখের খবর পাঠাচ্ছে, ওরা ভিতরে ঢুকে সব তছনছ করে দিচ্ছিল। জল কোথায়, জলের জন্য ওরা ওদের মগ, থালা এবং চামড়ার ব্যাগ খুলে রেখেছে, অথচ জল কোথায়, বৃদ্ধ পুরোহিত শুধু জানতেন জল কোথায়, তিনি সকলকে দু’হাত তুলে শান্ত থাকতে বলেছেন, সামান্য জলটুকু সকলকে সমান ভাগ করে দিতে হবে। তিনি প্রতি কামরায় একজন করে যুবককে জলের কল দেখিয়ে দিলেন, কী করে খুলতে হবে বন্ধ করতে হবে দেখিয়ে দিলেন, প্রত্যেককে লাইন দিয়ে যেমন মানুষগুলো সরকারের লঙ্গরখানাতে লাইন দিয়ে খাদ্যবস্তু থালায় নিত, তেমন লাইন দিয়ে সামান্য জলটুকু সকলকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে বললেন।