তাঁবুর ভিতরে বোধ হয় কী নিয়ে হাসি—মশকরা হচ্ছিল। ওরা খুব জোরে হাসছে। ওরা সুবলের কথা শুনতে পায়নি। সুতরাং সুবল পেছনের দিকে তাকাতেই দেখল সেই বৃদ্ধ লাঠি উঁচু করে রেখেছে। যেন এই লাঠিতে মোজেসের প্রাণ আছে। লাঠি এখন ওদের সব আশা পূরণ করবে। সে লাঠি তুলে ওপরে কী নির্দেশ করতেই সকলে বুঝে নিল, ওদের এবার এ স্থান পরিত্যাগ করতে হবে। ওরা বৃদ্ধের কথামতো পিছনে পিছনে চলতে থাকল। তাঁবুর চারপাশে পুলিশ ছিল কিছু… ওদের হাতে বন্দুক ছিল, গ্রামের মানুষেরা হিংস্র, ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠছে অথচ এই বন্দুক দেখলে তাদের প্রাণ শুকিয়ে যায়—ওরা অর্থাৎ এই—এই মানুষেরা, যারা হা—অন্নের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকছে, তাদের নীরবে অন্ধকারে নেমে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকল না।
অন্ধকারে বৃদ্ধ বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি সুবল?
—জানি না কর্তা।
—আমরা কোথাও যাচ্ছি না। আমরা এই পাহাড়ের ওপর আগুন জ্বেলে দেব। সব পুড়িয়ে দেব। যখন মাটি এত নেমকহারাম, ঈশ্বর এত বেইমান—যখন বৃষ্টি হচ্ছে না, যখন ঘাসমাটি পুড়ে গেল, সব তখন আমরা আগুন জ্বেলে বাকি যা আছে সব পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাব শহরে।
কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন রুখে উঠল। বলল, আমরা জল খেতে চাই কর্তা। তুমি সারাদিন বালুর ভিতরে পুরে রেখেছিলে জল দেবে বলে, কিন্তু জল কই?
দলের ভিতর শিশুদের কান্না, জল খাব। ওদের সকলের ভয়ঙ্কর তেষ্টা। বৃদ্ধ নিজেও তেষ্টায় মরে যাচ্ছে। ভিতরে এক ভয়ঙ্কর হিংস্রতা কাজ করছে। ক্ষণে ক্ষণে বুদ্ধি পালটায়। মনে হয় এই মাটি সোনার ফসল দেবে, আবার মনে হয় জল বুঝি এখানে আর কোনওদিন হবে না, মাটি আর সোনার ফসল দেবে না। সব শুকিয়ে যাবে তারপর একদিন এই অঞ্চল মরুভূমি গ্রাস করে নেবে।
তখন দূরের ট্রেনের হুইসল। বড় একটা ট্রেন বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসছে। কোথায় এক দিল্লি বলে শহর আছে, কোথায় এক কলকাতা বলে নগর আছে, সেখানে ট্রেনটা যাবে। দিল্লি থেকে কলকাতা। বৃদ্ধ এবার লাঠিটা শক্ত করে ধরে ফেলল। তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা এই লাইনের ওপর বসে যাও। শহর থেকে নগরে যাবার জন্য বড় ট্রেন আসছে। আজ আমরা ট্রেনটা থামিয়ে দেখব কী আছে, যদি ভিতরে জল থাকে, তবে আমরা জল নিয়ে চলে যাব। জলের জন্য অন্নের জন্য আমাদের এই দস্যুবৃত্তি। আমাদের কোনো পাপ হবে না।
সুবলের ভয় ছিল, ট্রেনটা হুড়মুড় করে এসে ওপরে উঠে যেতে পারে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, কর্তা, আমরা যে তবে সব মরে যাব।
—মরে যাবে কেন?
—ট্রেনটা আমাদের ওপর দিয়ে চলে যাবে।
—আরে না, ট্রেন মানুষের ওপর দিয়ে যায় না। এতগুলো লোক দেখলে ড্রাইভার ট্রেন থামিয়ে দেবে।
কর্তামানুষ এ বৃদ্ধ, এই অঞ্চলের পুরোহিত মানুষ, বিদ্যায় বুদ্ধিতে সকলের চেয়ে প্রবল সুতরাং সুবলের আর কোনও ভয় থাকল না। সে তার পাখি পিঠে রেখে দিল, সে তার ঝোলাঝুলি, বগলের নীচে ঝুলিয়ে রাখল। সুবল অন্ধকারে টিপে টিপে দেখল ঝোলাঝুলিতে ওর সংগ্রহ করা পোকামাকড়গুলো রয়েছে কিনা! কারণ সে খুব ভোরে উঠে পোকামাকড় সংগ্রহ করে রেখেছে পাখিটার জন্য। খুব ভোরে উঠে সে পাখিটাকে আকাশে ওড়াবার চেষ্টা করেছে। কারণ তখন প্রবল খরা থাকে না, ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকে, এবং খুব ভোরেই পাখিটা যেন সামান্য সতেজ থাকে। তারপর সূর্য ওঠার সঙ্গে পাখিটা গরমে ছটফট করতে থাকে। সুবলের মনে হয় সে পাখিটাকে আর বুঝি বাঁচাতে পারবে না। সে যখনই সামান্য অবসর পায় পাখিটাকে বাঁশের চোঙ থেকে তুলে এনে হাতের ওপর বসিয়ে রাখে। এবং নিজে সূর্যের দিকে পিঠ রেখে পাখিটাকে ছায়া দেয়। যদি ফুরফুরে হাওয়া থাকে তবে পাখিটাকে হাওয়া লাগাবার জন্য হাতের কবজিতে বসিয়ে সে আপন মনে শিস দিতে থাকে এবং গ্রাম্য কোনো সংগীত অথবা লোকগাথা সে কবিতার মতো উচ্চারণ করতে করতে, এই প্রবল খরা, মন্বন্তর আসছে, দুর্ভিক্ষ সারা দেশে, আবার ওলাওঠা মহামারীর আকারে দেখা দিচ্ছে, সুবল পাখিটাকে রক্ষা করার জন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন সে অন্য কোথাও পালাতে পারলে বাঁচে।
ভয়ঙ্কর অন্ধকার। এতগুলো মানুষ নিঃশব্দে হাঁটছে। পাতার শুধু খস খস শব্দ উঠছিল। ওরা প্রায় সকলেই বনবেড়ালের মতো চুপি চুপি রেললাইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের কান্না মাঝে মাঝে বড় ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল।
শালগাছের জঙ্গল সামনে। জঙ্গল পার হলে রেললাইন। শালগাছগুলো প্রায় মৃতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে গাছের ডালপালাগুলোকে খুব ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল। কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। কোনও গ্রাম থেকে একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না। মাঝে মাঝে শেয়ালের চিৎকার—আর এক ঝিল্লির ডাক, মনে হয় এই সংসারে জীবনধারণের আর কিছু থাকল না, কোনও আলো অথবা হাওয়া, সর্বত্র ভয়াবহ মৃতের গন্ধ শুধু।
বৃদ্ধ পুরোহিত রেললাইনে ওঠার আগে বললেন, বিবি—বউদের এবং শিশুদের আলাদা রেখে দাও। ওরা বড় কড়ুই গাছের নীচে বসে থাকুক।
বৃদ্ধ এবার যুবকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা হাতে সামান্য কাপড় নাও। ট্রেনের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাত ওপরে তুলে গাড়ি থামাবার নির্দেশ দেবে। বৃদ্ধ পুরোহিত এই সব বলে রেলের লাইনে কী নুয়ে যেন দেখল। তারপর সে সকলের আগে হাতে সেই লাঠি নিয়ে সামান্য সময় স্থির হয়ে দাঁড়াল। অপলক সে যেন কিছু দেখছে,—অন্ধকার, না এই জগৎসংসার, না পূর্বস্মৃতি তার কাজ করছিল। কী ছিল এই অঞ্চলে। বড় মাঠে সোনার ফসল ছিল, বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল, গোয়ালে বড় বড় গোরু, মোষ ছিল, শীতের সময়ে রামায়ণ—গান ছিল আর গ্রীষ্মকালে ঢোলের বাজনা ছিল, রামাহই রামাহই গান ছিল। এখন সব নিঃশেষ। কেবল ভয়, যা কিছু সামান্য মানুষ আছে তারাও চলে যাবে সব বাড়ি ছেড়ে। ভয়, মহামারী, মন্বন্তর এসে গেল। সামান্য খয়রাতি সাহায্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে আর কী থাকল মানুষগুলোর, কীজন্য আর অপেক্ষা করা। এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে মানুষগুলো বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বৃদ্ধ পুরোহিত অন্ধকারের ভিতর কোনও আলোর চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না।