ঠিক তখনই অর্জুনগাছের নীচ থেকে বৃদ্ধ চিৎকার করে বলল, তোমরা সকলে উঠে এসো।
সেই শব্দে আবার পাহাড়ের সঙ্গে সমতল ভূমিতে এবং ঢালু বালিয়াড়িতে প্রতিধ্বনি তুলে নেমে গেল। মানুষগুলো কোনও স্বপ্নলব্ধ আদেশের মতো সেই উঁচু পাহাড়ের দিকে যেতে থাকল।
সেই বালকটি তার পাখিটাকে চোঙের ভিতর রেখে পিঠে ছোট্ট একটা হুক দিয়ে ঝুলিয়ে দিল। তার সঙ্গে টিনের থালা—মগ ছিল একটা এবং সামান্য কাপড়জামা। কালো নোংরা পুঁটলিটা সে পিঠের বাঁ দিকে ঝুলিয়ে সকলের সঙ্গে উঠে যেতে লাগল পাহাড়ের দিকে।
বৃদ্ধ পাহাড়ের নীচে সামান্য এক সমতলভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুসন্ধান করে এই স্থানটুকু আবিষ্কার করেছে। কিছু গুল্মলতা দেখে সে বুঝে নিয়েছিল এই মাটির নীচে রসাল একরকমের শিকড় রয়েছে। সুতরাং খুঁড়ে খুঁড়ে এক পাহাড় রসাল শেকড় তুলে রেখেছে। তার শক্ত বাহু কাজ করার জন্য বড় বেশি পাথরের মতো কঠিন মনে হচ্ছিল।
বৃদ্ধ সকলকে প্রায় সমানভাবে ভাগ করে দিল। এবং বলল, চুষে খাও। তোমাদের তেষ্টা নিবারণ হবে।
মানুষগুলোর কাছে এই বৃদ্ধ মোজেসের মতো। এই দুর্দিনে এই একমাত্র মানুষ যে তাদের আশা দিয়ে বাঁচবার জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। তিনি কেবল বলছেন, জল হবে। এবার বর্ষায় জল হবে। জল হলে নদীর সব জল আমরা নেমে যেতে দেব না। বাঁধ দিয়ে আমরা জল আটকে রেখে দেব। সুদিনে দুর্দিনে জল আমাদের কাজে আসবে।
বৃদ্ধ আরও বলছিল, এই মাটি সোনার ফসল দেবে। এই মাটি ছেড়ে কোনো শহরে চলে গেলে—ভিখারি বনে যাবি, এই মাটিতে জল হলে আমরা সকলে মিলে সোনার ফসল ফলাতে পারি। বৃদ্ধ এইটুকু বলে পিতামহের আমলের এক মন্বন্তরের গল্প শোনাল।
সুবল কান খাড়া করে রাখল। নানারকমের বীভৎস দৃশ্য চোখের ওপর ভাসছিল সুবলের। বৃদ্ধ পুরাতন এক মন্বন্তরের গল্প শুনিয়ে বলল, সংসারে এমন হয় মাঝে মাঝে। তাতে ভেঙে পড়লে চলে না। মানুষ, গোরু—বাছুর পথে—ঘাটে মরে পড়ে থাকে। ঘরের ভিতর মৃতের দুর্গন্ধ। মহামারী আসে। গ্রামের পর গ্রাম ক্রমশ খালি হয়ে যায়।
পাহাড়ে পাহাড়ে ধুলোর ঝড় উঠছে। ওরা দলবেঁধে হাঁটতে থাকল। ওরা জানত, এই সামনের ঢালু বেয়ে নেমে গেলে বড় এক পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে। তারপর দু’ক্রোশের মতো হেঁটে গেলে রেললাইন, লাইনের ধারে লঙ্গরখানা খুলেছে সরকার, সেখানে পৌঁছুতে পারলে এক হাতা খিচুড়ি পাওয়া যাবে। এই সামান্য আহার সারা রাত্রির জন্য ওদের সামান্য শান্তি দেবে। তারপর ফের আগামীকাল নদীর ঢালুতে জলের সন্ধান চলবে। ক্রমশ এভাবে চলবে। কতদিন চলবে এভাবে ওদের জানা ছিল না। শুধু বৃদ্ধ আগে আগে হাঁটছে। হাতে লাঠি। সে মাঝে মাঝে হাতের লাঠি আকাশের দিকে তুলে দিচ্ছে, পথে—ঘাটে গোরু—বাছুর মরে পড়ে ছিল, পচা দুর্গন্ধ। কোনও গ্রামে ওরা মানুষের চিহ্ন দেখতে পেল না। কেবল দূরে ট্রেনের হুইসল শোনা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে।
ওরা সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় রেললাইনের ধারে পৌঁছাল। গ্রামটাকে উৎসবের মতো মনে হচ্ছিল। বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষেরা এসে বসে রয়েছে। বড় বড় অর্জুন গাছের নীচে খড়বিচালি বিছিয়ে বউ—বিবিরা শুয়ে আছে, খাবার হয়ে গেলে টিনের থালা এবং মগ নিয়ে সকলে লাইন দেবে। অবশ্য শিশুদের এবং বালক—বালিকাদের খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা খেলে খাবে বুড়ো—বুড়িরা এবং বউ—বিবিরা। তারপর যুবক এবং মরদ মানুষেরা।
উৎসবের মতো এই গ্রাম। ব্যাজ পরা একদল মানুষ। বড় বড় তাঁবু খাটানো হচ্ছে। ডে—লাইট জ্বলছে, কোনও পরিত্যক্ত ধনী গৃহস্থের বাগানবাড়ি হবে এটা। প্রায় দশ—বারোটা উনুনে লোহার বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি ফুটছে। ত্রিপাল গোল করে মাটির গর্তে খিচুড়ি রাখা হচ্ছে। বড় বড় কাঠের হাতা নিয়ে বড় বড় বালতি নিয়ে ব্যাজ পরা মানুষগুলো ছুটোছুটি করছে। কিছু লোক কোথায় গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, একদল স্বেচ্ছাসেবক সেদিকে ছুটল। ওরা লুকিয়ে খাবার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
বড় বড় মোষের গাড়িতে শহর থেকে জল এসেছে। বড় বড় মাটির জালা জল ভর্তি ছিল, এখন সেই জল নিঃশেষ। কেউ খিচুড়ি খাবার পর এক ফোঁটা জল খেতে পারছে না। মানুষগুলোর মুখে বিরক্তির ছাপ এবং উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে।
জল নেই, খাবার জল নেই। এই অঞ্চলে পাঁচ—সাত ক্রোশ এমনকি দশ ক্রোশ হবে জল নেই—খাবার জল নেই, পাতকুয়াতে কোথায় সামান্য জল একজন গেরস্থ মানুষ লুকিয়ে রেখেছিল—সেখানে খণ্ডযুদ্ধ মানুষের সঙ্গে মানুষের। কারণ কে যেন বলছিল এই দুর্দিনে জল লুকিয়ে রাখতে নেই।
তখন তাঁবুতে তাঁবুতে সরকারের লোক সব ফিরে যাচ্ছিল। জলের কথা বললে ওরা না শুনি না শুনি করে পেতল—কাঁসা যা ছিল কিছু সামনে তা দিয়ে কান ঢেকে দিল। অর্থাৎ ওরা কিছু শুনতে চাইল না। উপরন্তু তাঁবু থেকে হ্যাট পরা মানুষটা বের হয়ে বলল, কাল থেকে লঙ্গরখানা বন্ধ। কতদিন বন্ধ থাকবে জানা নেই, গুদামখানায় চাল—ডালের মজুত শেষ। আবার কোথা থেকে গম আসছে, আসার যদি কথা থাকে তবে এখানে দু’—চারদিন রুটি মিলতে পারে আবার নাও মিলতে পারে। সরকারের লোকটি নিজের দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে তাঁবুর ভিতর ঢুকে গেল।
মানুষগুলো, কত মানুষ হবে—প্রায় হাজার মানুষ, ছেলে বউ—বিবি নিয়ে হাজারের ওপর হতে পারে, বিশেষ করে সুবল, যার বাঁশের ভেতর ময়না পাখির বাচ্চা, বাচ্চাটাকে সুবল একটা মরা গাছের নীচে কুড়িয়ে পেয়েছিল। কারণ পাখিরা পর্যন্ত ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, জলের অভাবে, শস্যের অভাবে এখন আর কোনও পাখি পর্যন্ত ডাকে না—সুবল সেই মরা গাছের ডালে একটা ভাঙা বাসা দেখেছিল। বোধ হয় পাখিটা বাসা থেকে পড়ে গেছে। পাখিটা জলের জন্য অথবা ক্ষুধায় দু’ঠোঁট ফাঁক করে দিচ্ছিল—সুবল পাখি নিয়ে ছুটে ছুটে ওর যে শেষ সামান্য সঞ্চিত জল ছোট কাচের শিশিতে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই জল থেকে প্রায় মধুর মতো একটু একটু করে জল দিতেই পাখির বাচ্চাটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। সুবল হাতে তালি বাজাল এবং এতবড় খরা চলেছে, মন্বন্তর এসে গেল দেশে—এই পাখি মিলে যাওয়ায় ওর ভয় যেন কেটে গেল। সেই সুবল যাকে দেখলে এখন ভিড়ের মধ্যে মনে হল বড় কাঙাল, সরল সহজ—গোবেচারা সুবল পিঠে বাঁশের ভেতরে পাখি নিয়ে এগিয়ে গেল। বলল, আমরা খেতে না পেলে মরে যাব।