সুবল বলল, দিদিমণি ওর পাখায় কত রাজ্যের স্বপ্ন দেখো।
সুবল বলল, দিদিমণি পাখির পায়ে কত রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখো।
তারপর সুবল কেমন নেচে নেচে বলতে থাকল, আকাশ দেখো, সমুদ্র দেখো, দেখো দেখো মাঠ দেখো, পাহাড় দেখো, পাখিটা সেই দেখার মতো ঘরের ভিতর উড়তে থাকল, সমুদ্র দেখার মতো বাতাসের উপর ভাসতে থাকল, নদী দেখার মতো এঁকেবেঁকে সোজা উপরে নীচে উঠে গেল। টুকুন সব দেখছিল। জাদুকর তার পাখির খেলা দেখাচ্ছে। জাদুকর এই ঘরে পাখির খেলা দেখিয়ে সকল দুঃখ যেন দূর করে দিচ্ছে।
টুকুন মনপ্রাণ ঢেলে এই পাখির খেলা দেখতে থাকল। ভিতরে সেই শির শির ভাবটা কাজ করছে। ভিতরে, সেই প্রাণের ভিতরে শির শির ভাবটা কাজ করছে। যেন শরীরের সর্বত্র রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে। শরীরের ভিতরে কোথাও এক হীরামন পাখি এতদিন চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিল এই পাখির খেলা দেখতে পেয়ে সে—পাখি আকাশে ওড়ার জন্য ডানায় যেসব রাজ্যের ক্লান্তি জমে ছিল এতদিন, তাই উড়িয়ে দিল। প্রাণের ভেতরে এক পাখি আছে, ওড়ার পাখি, সেই পাখির আজ কতদিন পর যেন ওড়ার প্রত্যাশায় চোখে মুখে হাসির আনন্দ, হায় এই হাসির আনন্দ কোথাও শেষ পর্যন্ত থাকে না, মানুষেরা এই হাসির আনন্দ প্রাণের কখন যেন বড় হতে হতে হারিয়ে ফেলে।
টুকুন ধীরে ধীরে দেখল অনেকক্ষণ ওড়ার পর পাখিটা ক্লান্ত হয়ে সুবলের মাথায় গিয়ে বসেছে। রাত বাড়ছিল। সুবল ধীরে ধীরে জানালা থেকে নেমে ফের দেবদারু গাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। টুকুন জোরে চিৎকার করতে চাইল, সুবল তুমি আবার কাল এসো। আমি জানালায় তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এবং পিছনে দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল নার্স দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। টুকুন এতক্ষণে বুঝতে পারল নার্সের ভয়ে সুবল চুপি চুপি কিছু না বলে পাখি নিয়ে চলে গেছে।
সাত
জনার্দন বুঝতে পারল, আর রক্ষা নেই। মাটি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। মরুভূমির মতো উত্তাপে গাছপালা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। কোথাও সামান্য রস সঞ্চিত নেই। এখন এই পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে শুধু মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করে বসে থাকা। জনার্দন মন্দিরের ভিতর পায়চারি করছিল। হাত—পা শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। চোখে আর প্রায় দৃষ্টি ছিল না। সে এখন আর পাহাড়ের ওপর উঠে পাথর নিক্ষেপ করতে পারছে না। সমস্ত উদ্যম নিঃশেষ হয়ে গেল।
দাবানলের মতো জ্বলে সূর্য অস্ত চলে গেল। জনার্দন অভ্যাসমতো বের হয়ে পড়ল। চোখের দৃষ্টি কমে আসছে বলে সে ধীরে ধীরে পরিচিত পথ ধরে পাহাড় থেকে নেমে সমতল পথ ধরে হাঁটতে থাকল। আজ প্রায় চারদিন হল জনার্দন শুধু জল খেয়ে আছে। জনার্দন আজও শেষবারের মতো বের হয়ে পড়ল। যদি কোনও আহার্য বস্তু সংগ্রহ করতে না পারে, যদি পাহাড়ময় এবং মাঠময় কোনও মৃত জীবজন্তু অথবা ঘাসপাতা সংগ্রহ করতে না পারে তবে মনে হচ্ছিল মৃত্যু অবধারিত। এই মৃত্যু ওকে গ্রাস করবে ক্রমশ। এখন আর পায়ে শক্তি নেই যে সে দূরের কোনও শহরে অথবা গঞ্জে চলে যাবে। ষাট সত্তর মাইল হেঁটে যাবার শক্তিটুকু জনার্দনের শেষ হয়ে গেছে। সে হাঁটছিল এবং মাঝে মাঝে আবেগে মা মা বলে ডেকে উঠছিল।
জনার্দনের হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সংসারে একরকমের তেষ্টা আছে যা কোনওকালে নিবারণ হয় না। একরকমের অভাব আছে যা কখনও দূর হয় না। আর একরকমের অহঙ্কার আছে যা কোনওকালে শেষ হয় না। জনার্দনের সেই অহঙ্কার। শস্যশ্যামলা এই দেশে প্রথম পিতৃপুরুষেরা আসেনি। পাহাড়ি অঞ্চল ছিল। সেখানে লোকালয় বিশেষ ছিল ন। নির্জন এক পাহাড় ঘেরা প্রান্তরে সামান্য ক’ঘর আদিবাসীর ভিতর তার কোনও পিতৃপুরুষ এসেছিল সুবচনি দেবীর ভার কাঁধে নিয়ে। সে এসেছিল বলে, দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে, এবং দিনমান এই মাঠের ভিতর উপুড় হয়ে পড়ে থেকে সব ঘাসবিচালি তুলে নিয়েছিল বলে বর্ষার শেষে কী ফসল, কী ফসল। এত ফসল হয় মাটিতে মানুষের জানা ছিল না। পাহাড়তলি অঞ্চল থেকে মানুষজন ফসলের লোভে চলে এসেছিল—আর যায়নি। তার পূর্বপুরুষ এক বন্ধ্যা মাটিকে উর্বরা ভূমি করে সংসারে প্রায় পির সেজে গেল। তারপর থেকেই বংশের ভিতর এক নিদারুণ অহঙ্কার। উৎসবে, পালাপার্বণে মানুষের সুখে দুঃখে সব সময় এই দেবীর সেবাইত প্রায় ঈশ্বরের সমতুল্য। জনার্দন হাঁটতে হাঁটতে ফের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মা মা—মা সুবচনি তুই নিষ্ঠুর হলে চলবে কেন—আমার অহঙ্কার মুছে দে মা। সামান্য বৃষ্টি দে মা। রাগ করে মা কার ঘরে বসে আছিস। বৃষ্টি দে মা, মাঠে ঘাসবিচালি গজাক। পাখি—পাখালি উড়ে আসুক মা। গাছে গাছে ফুল ফুটুক। ফল হোক মা গাছের শাখা—প্রশাখাতে। তোর লীলা মা আর কতকাল চলবে।
কিন্তু হায় কার কথা কে শোনে। শেয়াল ডাকছে না। কুকুরের আর্তনাদ নেই কোথাও। চারিদিকে বীভৎস জ্যোৎস্না! সাদা আলো মাঠময়। সেই মাঠের ভিতর বসে একসঙ্গে কারা যেন নিত্য কেঁদে চলেছে। জনার্দন একটু থমকে দাঁড়াল। কারা কাঁদছে! ঠিক যেখানে নদী সামান্য বাঁক নিয়েছে, যেখানে ক’ঘর মুন্ডা জাতীয় আদিবাসী ছিল, এবং যেখানে পেটের জ্বালায় ঘরের এক বউ ফাঁসি দিয়েছিল সেইসব মাঠে এবং গাছের ভিতর একদল মেয়ে যেন হাজার হবে, তার বেশিও হতে পারে বসে বসে কাঁদছে। জনার্দনের প্রায় পা চলছিল না। এমন বীভৎস দৃশ্য জনার্দন কোনওকালে যেন দেখেনি। হাজার ঘোড়া ছুটছে। ঘোড়ার পিঠে সব নারী—পুরুষের মুখ ঝুলছে। দেহ নেই। শুধু মুখ। তারপর একটা কালো ঘোড়া যেন ছুটে গেল, সেই ঘোড়ার পিঠে শুধু এক তরবারি। তারপর মনে হল সুবচনি দেবী মাঠের ভিতর ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। ছোট সুবচনি দেবী হাত পা বিশাল করে, স্তনে সন্তান ঝুলিয়ে ঠিক কোনও ভৈরবীর মতো দু হাত ওপরে তুলে জনার্দনের দিকে এগিয়ে আসছে। আর মনে হল হাজার হাজার কঙ্কাল সেই সুবচনি দেবীর চারপাশে আনন্দে নৃত্য করছিল। জনার্দন এবার বলল, মা আমার আর কোনও অহঙ্কার নেই মা। আমি ক্ষুধার জন্য অন্ধ হয়ে যাচ্ছি মা। মা আমার এই পিতৃপুরুষের দেশকে শ্মশান করে দিলি মা। আমি যে মা বড় ঘোরে পড়ে যাচ্ছি। জনার্দন হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল।