জানলার দিকে মুখ ছিল টুকুনের। স্প্রিং—এর খাট, শিয়রের দিকটা একটু উঁচু করা। টুকুনদিদিমণির চোখ ঘোলাটে, যেন স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। প্রায় অন্ধের মতো—অথবা সংজ্ঞাহীনের মতো ঠিক যেন তার সেই খরা অঞ্চল, কোনওকালে বৃষ্টি পায় না আর ফসল ফলবে না, সোনার ফসল ঘরে তুলে কেউ আর উৎসবে পার্বণে আলো জ্বালবে না। সে ফিস ফিস করে ডাকল, দিদিমণি, দিদিমণি আমি সুবল চিনতে পারছ না? আমাকে তুমি চাদর দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলে, আমাকে তুমি পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলে। আমি পাখিয়ালা সুবল।
—কে? সুবল!
—হ্যাঁ আমি সুবল। আমি তোমাকে কুঁচফল দিয়েছি।
—তুমি আমাকে রঙবেরঙের পাথর দিয়েছ সুবল।
—আমি তোমাকে চন্দনের বীচি দিয়েছি।
—আমার শিয়রে সব আছে।
—কৈ দেখি। সুবল দু পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে উঁকি দিল। কিন্তু অবাক টুকুন তার হাত—পা নড়াতে পারল না।
সুবল বলল, কৈ দেখি। তোমার শিয়রের নীচে কোথায় রেখেছ দেখি।
টুকুন বলল, নার্স এলে বলব। নার্স শিয়রের নীচ থেকে চন্দনের বীচি বের করে দেখাবে।
—কেন তুমি পারো না!
—না সুবল। আমি পারি না। আমি হাঁটতে পারি না সুবল। কতদিন আমি হাঁটি না। কতদিন আমি মাঠে মাঠে হেঁটে বেড়াইনি। বলে দুঃখী এক মুখ নিয়ে সুবলের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর সামনের মাঠে যে আলো জ্বলছিল, সামনের পার্কের বেঞ্চগুলোতে যে মানুষগুলো বসেছিল তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, জানো সুবল কেউ বিশ্বাস করে না। আমি ট্রেনে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম, ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। বলে সে আঙুলে সমস্ত ফুলপরি, জলপরি, রাজা এবং অন্যান্য পুতুলদের উদ্দেশ্য করে দেখাল।
সুবল বলল, যা তুমি আবার হাঁটতে পারবে না কেন? তুমি ঠিক হাঁটতে পারো।
—আমি হাঁটতে পারি তাই না সুবল? আমি ট্রেনে হেঁটেছিলাম তাই না সুবল। বলে সে খুব উচ্ছ্বল হয়ে উঠল।
—তুমি এখন হাঁটতে পারো।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হল টুকুন খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। সে আর সুবলের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। কী যেন ভাবছে। সে সুবলকে বলতে চাইল, আমি আর হাঁটতে পারি না। তোমাকে ইচ্ছা হয় বারবার হেঁটে দেখাই। কিন্তু সুবল আমি সত্যি পারি না এখন। গায়ে শক্তি নেই। হাতে পায়ে স্থবির একভাব সব সময়।
টুকুনের চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল ফের। ভিতরে লজ্জাকর অনুভূতি। বড় মাঠ সামনে, আর এতসব ট্রাম বাস চোখের উপর দিয়ে ছুটছে, এতসব মানুষজন পথ পার হয়ে যাচ্ছে—ওদের দেখে টুকুনের ভিতর সব সময় অসহিষ্ণু ভাব। টুকুন ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল।
সুবল যেই দেখতে পেল, টুকুনদিদিমণির চোখ ফের ঘোলা হয়ে যাচ্ছে—সে বলল, টুকুনদিদিমণি, তুমি হাঁটতে পারো। তুমি হেঁটে হেঁটে ইচ্ছা করলে, অনেক দূরে চলে যেতে পারো।
আমি হাঁটতে পারি সুবল তুমি বলছ?
টুকুন এবার তার খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে রাজা এখন বুঝতে পারছিস, আমি হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলাম। এই দেখ সুবল, পাখিয়ালা সুবল, সব দেখেছে। ওদের দেশে খরা বলে ও কলকাতায় চলে এসেছে। ওর সঙ্গে ট্রেনে কত কথা বলেছি। ওর পাখিকে আমি খেতে দিয়েছি। আমি তোদের মতো নেঙ্গু নইরে। তোদের মতো এক জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে থাকি না।
সুবল বলল, এই যে পাখি দেখছ, ওর কেউ ছিল না। একদিন ফিরে আসার সময় দেখি গাছের নীচে পড়ে ছটফট করছে। ওর মা বাবা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখে বুঝি পালিয়েছিল। পাখিটা নড়ে না, খায় না, পাখির চোখ ঘোলাটে। এই পাখি সকলে বলল মরে যাবে, আমি পাখিকে নিয়ে মাঠে চলে গেলাম, সবুজ কীটপতঙ্গের ছানা খুঁজে বের করলাম। অতল জলের স্বাদ মুখে দিলাম। নদীর জলে স্নান করালাম, সুবচনি দেবীর মন্দিরে গিয়ে মানত করলাম, মা আমার পাখিকে উড়িয়ে দে আকাশে, উড়িয়ে দে সব, পাখির চোখে নদীর জল লেগে পাথরের মতো কালো হয়ে গেল। সবুজ কীটপতঙ্গের ছানা খেয়ে পাখা গজালো, অতল জলের স্বাদ পেয়ে পাখি তাজা হল—কিন্তু হায় পাখি আমার আকাশে ওড়ে না, চলে না ফেরে না। পাখিকে নিয়ে কী কষ্ট! মাঠে নেমে পাখিকে বলতাম ঐ দেখ বড় মাঠ, ঐ দেখ বড় গাছ, আপন প্রাণের তেজে পাখি আকাশে উড়ে যা! সে কী দৌড়ঝাঁপ গেছে। খরা চলছে গ্রামে মাঠে, মানুষ রোদে বের হতে চায় না, আমি পাখিকে শুধু বললাম, পাখি, আপন প্রাণের তেজে পাখি আকাশে উড়ে যা। একদিন দুদিন গেল, মাস গেল, এবং মাঝে মাঝে আমরা নদীতে জলের সন্ধানে বের হতাম, পাহাড় চারপাশে, কত গাছপালা ফুল ফল পাখি ছিল, খরায় সব পুড়ে গিয়েছে। চারদিকে তাকালে কান্না পায়, জল খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে পাখিকে বলতাম—উড়ে যা। আপন প্রাণের আবেগে উড়ে যা। বলে সুবল নিজের পাখিকে বলল, উড়ে যা, তোর টুকুনদিদিমণি দেখুক—সঙ্গে সঙ্গে পাখি উড়তে থাকল ডিগবাজি খেতে থাকল—কোথাও উড়ে গিয়ে নিমেষে ফিরে এল, রাজার মাথায় বসেছে কিন্তু মলমূত্র ত্যাগ করলে মনে হল চোখের নীচে রাজার পিচুটি। রাজা যেন হাপুস নয়নে কাঁদছে।
তখন সুবল বলল, দেখ দিদিমণি দেখ, তোমার রাজার চোখে পিচুটি, রাজা কেমন মুখগোমড়া করে আছে। টুকুন ঘাড় ফিরিয়ে রাজাকে দেখতে পেয়েই হো হো করে হেসে উঠল।—ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়েছে। পাখি তোমায় উচিত শাস্তি দিয়েছে। পাখিটার কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। পাখি আকাশে ওড়ার মতো ঘরের ভিতর দোল খেয়ে উড়ছে।