বিকালের দিকে টুকুনের বাবা সুরেশবাবু এলেন। ওদের পারিবারিক ডাক্তার এলেন। এবং টুকুনের মা শিয়রে বসেছিল। নার্স, সকালের দিকে টুকুন সংজ্ঞাহীন হয়েছে আজও—খবরটা সুরেশবাবুকে দিতে গিয়ে সেই পাখিয়ালার গল্পও করে ফেলল।
সুরেশবাবু বললেন, সে এখন কোথায়?
নার্স দেবদারু গাছটার দিকে হাত তুলে বলল, ওর নীচে বসে জুতো পালিশ করছে। সকালের দিকে এসেছিল। খুব বিরক্ত করছিল টুকুনকে। তাই তাড়িয়ে দিয়েছি।
—ওর পাখিটা এখনও আছে?
—পাখিটাকে নিয়েই ত সব ঝামেলা। ঘরের ভিতর ঢুকে কেবল ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে। আমার কথা শুনছে না, পাখিয়ালার কথা শুনছে না। ডাক্তারবাবুরা খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন। ভয়ে ভয়ে আমি তখন ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলাম। সে পাখি নিয়ে দেবদারু গাছের নীচে বসে আছে।
নার্স ভুলে গেল পাখিটা যখন উড়ছিল তখন টুকুনের মুখে সামান্য সজীবতা লক্ষ্য করা গেছে। নার্স ভুলে গেল বলতে সংজ্ঞাহীন অবস্থা থেকে টুকুন পাখির ডাক শুনে জেগে উঠেছে। আর ভুলে গেল বলতে পাখিয়ালা বিশ্বাস করছিল না, টুকুন বাঁচবে না।
মা টুকুনের কপালে হাত রাখল। টুকুনকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। খেলনাগুলো সব একদিকে জড়ো করা। নার্স বিকেলের দিকে চুল বেঁধে দিয়েছে। মুখে সামান্য পাউডার। মুখের এনিমিয়া ভাবটা এখন আর তত স্পষ্ট নয়। সকলের মুখই বিষণ্ণ। বিশেষ করে টুকুনের মা সারাক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন, এখন আর আমাদের কিছু করণীয় নেই।
—না কিছু করণীয় নেই।
—সংক্ষেপে বুঝলেন সুরেশবাবু, ডাক্তারবাবু কেমন বিচলিতভাবে কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
—আপনি উদ্যমহীনতার কথা বলতে চাইছেন।
—হুঁ আমরা কেমন যে ক্রমশ উদ্যমবিহীন হয়ে পড়ছি সকলে।
—তিনি একটু থামলেন, তারপর টুকুনের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। ওর ভিতরের কলকবজাগুলো ঠিকমতো প্রথম থেকেই কাজে লাগেনি।
সুরেশবাবু বললেন, কিন্তু আমার দিক থেকে ত’ কোনও ত্রুটি ছিল না ডাক্তারবাবু।
আর তখন কে যেন পথে পথে বনে বনে বলে গেল, কে যেন হেঁকে হেঁকে গেল, পথ দিয়ে মানুষ যায় দেখ, ঘোড়া যায় গাড়ি যায় দেখ, দুঃখ যায় সুখ যায় দেখ। দেখ দেখ মানুষ কত মানুষ, কত হিসাবের মানুষ পোস্টার মারছে দেয়ালে—খেতে পায় না, অনাহারে দুর্ভিক্ষে মানুষ সব গ্রামে মাঠে মরে থাকছে।
অথবা যেন পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল শহরটা—জল চাই, অন্ন চাই। শুধু লেখা ছিল না উদ্যমবিহনে কিবা পূরে মনোরথ! সুরেশবাবু নিজের চোখে মেয়ের চোখ দেখছিলেন, এক দুরারোগ্য ব্যাধি এই মেয়ের! ঠিক যেন তার কলকারখানার মতো। আয় নেই, ব্যয় বাড়ছে, শ্রমিকেরা উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। টাকার দাম কমছে, জিনিসপত্র আকরা। এক রোগ তার কলকারখানাকে উৎখাতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই তিনি সে ক্ষয় থেকে তাকে রক্ষা করতে পারছেন না…ঠিক যেন এই মেয়ে, যে ইচ্ছা করলেই বেঁচে উঠতে পারে ভিতরের উদ্যমহীন এক ক্ষতজাত রক্ত কিছুতেই তাকে সুস্থ হতে দিচ্ছে না।
সুরেশবাবু যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন, তোরা বল, বুকে হাত দিয়ে বল, যা এখন উৎপাদন করছিস, তোরা মনপ্রাণ দিলে তার দ্বিগুণ দিতে পারিস।
এক দৈত্য বোধহয় নিয়মের দৈত্য অথবা আদাইয়ের দৈত্য হু হু করে হেসে উঠল—স্যার আপনি কী জলে ডুবে স্বপ্ন দেখছেন। আমরা কী আর উৎপাদন বাড়াতে পারি!
সুরেশবাবু মেয়ের মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন। ভিতরে মেয়ের সেই ক্ষতজাত রক্ত কেবল ভিতরে ঘুরে ঘুরে আমরণ পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য লড়াই। যেন এই মেয়ে তার নিজের ভিতরেই ক্ষয়কে ভালোবেসে পুষে রেখেছে। সে বলল, টুকুন তুমি ঐ দেখ পাখিয়ালা সুবল এসে গেছে। তুমি তখন হাতে তালি বাজিয়েছিলেন, এখন পারো না। ঐ দেখ সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে জুতো পালিশ করছে। তাকে ডাকব?
টুকুন হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। যেন কোনও অমল আনন্দের খবর বয়ে আনার মতো মানুষ তার আর নেই।
সে শুধু বলল, বাবা জল খাব। জল।
সুরেশবাবু নার্সকে জল দিতে বলে বের হয়ে গেলেন। যে বাঁচতে চায় না, তাকে বাঁচিয়ে লাভ নেই। সুরেশবাবুর মুখে অবসাদের চিহ্ন। তিনি বড় বড় হাই তুলতে থাকলেন।
সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে ছিল। রাস্তায় আলো জ্বলছে। ফুটপাতে মানুষের ভিড়। কোথায় কী গণ্ডগোল হয়েছে, সহসা শহরের ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে গেল। মানুষেরা পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে। কিছু টেম্পো, লরি এবং রিকশা মানুষ বইছিল, রাস্তা ফাঁকা বলে সব ছোট ছোট ছেলের দল রাস্তার উপর বল খেলেছিল, ক্রিকেট খেলছিল এবং হাডুডু খেলছিল।
অথচ দেবদারু গাছটার নীচে বসেছিল সুবল, রাতে সে এই গাছের নীচে শুয়ে থাকবে। সঙ্গে ওর ছোট এক সতরঞ্চ আছে, অপরিচ্ছন্ন হলে সে সব গঙ্গার জলে ধুয়ে নেয়। আর ঐ গাছের নীচ থেকে টুকুন দিদিমণির জানালা স্পষ্ট। এখন মনে হচ্ছে দিদিমণির ঘরে কেউ নেই। ঘর ফাঁকা। শুধু সেই রাজা, কিছু পরি এবং বিড়াল, কুদুমাসির মুখ দেখা যাচ্ছিল। সে তার পাখির দিকে মুখ তুলে তাকাল। পাখিটা দাঁড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। সে এবার সব গোছগাছ করে কাঁধে ফেলে জানলার দিকে এগুতে থাকল, যখন কেউ নেই, জানলা দিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঘরে একটা নীল আলো জ্বলছে, তখন সুবল কিছুতেই দেবদারুর নীচে বসে থাকতে পারল না। কী এক অপরিসীম ভালোবাসা আছে টুকুনদিদিমণির, টুকুনদিদিমণি ছুটে গিয়েছিল দরজায়, দরজা খুলে বলেছিল, এখানে কেউ নেই, এ কামরায় কেউ ঢোকেনি। বলে পুলিশের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল—সেই থেকে মনে হয়েছে সুবলের এমন ভালোবাসার জন আর তার কেউ নেই। এমন আপনার জন তার আর পৃথিবীতে কেউ নেই। টুকুনদিদিমণিকে সে যেন ইচ্ছা করলে সব দিয়ে দিতে পারে। আর এই যে পাখি, যার মূল্য সুবলের কাছে প্রাণের চেয়েও অধিক, ইচ্ছা করলে সুবল টুকুনদিদিমণিকে খুশি করার জন্য সেই অমূল্য ধনও উড়িয়ে দিতে পারে। তার যা কিছু সম্বল, যা কিছু সঞ্চয় সব এই টুকুনদিদিমণিকে দিয়ে দিতে পারে। ঘর ফাঁকা দেখে সে কিছুতেই আর গাছের নীচে বসে থাকতে পারল না—জানালায় এসে কাঁধ থেকে ঝোলাঝুলি নামিয়ে ফিস ফিস করে ডাকল, টুকুনদিদিমণি আমি এসেছি।