জনার্দন হাঁটতে হাঁটতে ফের বলল, বেশিদিন আর নেই। আমি মরে গেলে মনে করবি না, তোকে ওখানে বসিয়ে রাখব। তোকে বুঝলি সুবচনি, তোকে তোর ছেলেকে নিয়ে ঐ যে পাহাড় দেখছিস সেখানে নিয়ে যাব। পাথরের নীচে রেখে পাষাণের ভার চাপিয়ে দেব। তবু যদি তোর চোখে জল না আসে দুঃখে, তবে তোর মুখে মুতে দেব।
তখন সুবল দেবদারু গাছের নীচে বসে জুতো পালিশ করছিল। পাখিটা দাঁড়ে বড় বেশি ছটফট করছে। বড় বেশি কিচমিচ করছে। পাখিটার তবে বুঝি জল তেষ্টা পেল। সে বাটিতে করে সামান্য জল দিল পাখিটাকে। কিন্তু পাখি জল খেল না। পাখা ঝাপটাতে থাকল। এবং পা দিয়ে বাটির জল উলটে চিঁ চিঁ করে কাঁদতে থাকল!
পাখিটাত এমন করে না কোনওদিন! সুবল ভাবল। সুবল অস্বস্তি বোধ করছে। পাখিটা ছটফট করলে ওর বড় কষ্ট হয়। সে ভালোভাবে জুতো পালিশে মন দিতে পারছিল না। সুতরাং লোকটা রেগে মেগে পয়সা না দিয়ে চলে গেল।
সুবল ভাবল, বাঁচা গেল। লোকটি পয়সা দেয়নি বাঁচা গেল। লোকটি চলে গেছে, সুতরাং সুবল এখন পাখিটার দিকে ভালোভাবে মন দিতে পারবে। সে ওর ক্রিমের কৌটার মুখ বন্ধ করে ব্রাস দিয়ে কাঠের বাক্সটাতে একটা বাড়ি মারল, তারপর ব্রাসটা নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এই সাতসকালে তোর কী হল বাপু।
পাখিটা দাঁড় থেকে উঠে সুবলের হাতে ঠোকরাতে থাকল। সুবল কী ভেবে বলল, আমাকে ভালো লাগছে না। তবে যা, উড়ে যা। বলে সে পা থেকে শেকল খুলে দিল। আর শেকল খুলে দিতেই পাখিটা সামনের দেবদারু গাছ অতিক্রম করে সামনের ছোট মাঠ পার হয়ে একটা জানালায় গিয়ে বসল। আর সেখানে বসে সেই আগের মতো প্রাণপণে চিঁ চিঁ করতে থাকল।
সুবল কিছু একটা ঘটবে, ঘটেছে ভেবে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখল ঘরের ভিতর টুকুনদিদিমণি, সংজ্ঞাহীন, বড় বড় ডাক্তার, অনেক খেলনা চার ধারে। পাখিটা কিচ কিচ করছে বলে নার্স ছুটে এসে পাখিটাকে উড়িয়ে দিতে চাইলে, সুবল বলল, আমাদের টুকুনদিদিমণি না? টুকুন টুকুনদিদিমণি, সে খেপা বালকের মতো ডাকতে থাকল, সে এত উত্তেজিত যে এইসব বড় বড় ডাক্তারদের আদৌ ভ্রুক্ষেপ করল না। সে জানালার ওপরে উঠে গেল। পাখিটা সুবলের উত্তেজনা যেন ধরতে পারছে, পাখিটা সুবলের চারপাশে এখন উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সুবল ডাকছে, টুকুনদিদিমণি আমি এসে গেছি। আমি তোমাকে কত খুঁজে খুঁজে ফিরে গেছি। এই দেখ টুকুনদিদিমণি সেই দুষ্টু পাখি, দেখ নীল লাল কুঁচ ফল।
একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল তুমি কে বাপু।
—আমি সুবল। সুবল আমি। আমরা ট্রেনে করে আসছিলাম…।
—অঃ তুমি সুবল। নার্সের মনে হল যেন সেই এক গল্প টুকুনের মা বাবা করে গেছে, এক সুবল, পাখিয়ালা সুবলকে দেখে টুকুনদিদিমণি হাতে তালি বাজিয়েছিল। সেই সুবল এসে গেছে। নার্স এবার ধীরে ধীরে বলল, টুকুনদিদিমণির খুব অসুখ। টুকুনদিদিমণি বাঁচবে না।
সুবল বলল, বাঁচবে না কেন?
—ওর ভয়ঙ্কর অসুখ।
—কী অসুখ।
—নার্স অসুখটার নাম করতে পারত। কিন্তু সাধারণ এক পাখিয়ালা সুবলকে এত ফিরিস্তি দিয়ে কী লাভ। সে বলল, তুমি অতসব বুঝবে না। তুমি যদি টুকুনদিদিমণিকে দেখতে চাও, ঘুরে সামনের দরজায় এসো।
—আমি ত এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি টুকুন দিদিমণিকে। দিদিমণি ঘুমুচ্ছে।
নার্স এবার বিরক্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছে।
—জাগলে একবার ডেকে দেবেন। আমি দেবদারু গাছটার নীচে রয়েছি। আমার কথা আছে অনেক। টুকুনদিদিমণি বলেছিল কলকাতায় এলে আমি যেন ওর সঙ্গে দেখা করি।
নার্স বলল, এখন যাও বাপু। ডাক্তারবাবুরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন। তুমি গিয়ে চুপচাপ দেবদারু গাছের নীচে বসে থাক।
—দিদিমণির বাবা মাকে দেখছি না?
—ওরা বিকেলে আসবে। তুমি যাও বাপু। কথা বল না। ডাক্তারবাবুরা বিরক্ত হচ্ছেন।
—তবে আমার পাখিটা এখানে থাকল।
—পাখি আবার কেন।
—দিদিমণি জাগলে সে আমাকে ডেকে দেবে।
—না বাপু পাখি টাখি রেখ না। তুমি তোমার পাখি নিয়ে চলে যাও। টুকুন জাগলে তোমায় ডেকে দেব।
—সত্যি ডেকে দেবে ত?
নার্স বিরক্তি প্রকাশ না করে আর থাকতে পারল না, যাও বলছি।
—যাচ্ছি। সে পাখিটাকে ডাকল, আয়।
পাখিটা নড়ল না। পাখিটা গরাদে বসে ঠোঁট মুছতে লাগল।
সুবল বলল, এ এখন যাবে না। আমি যাচ্ছি। পাখিটা আপনাদের কোনও বিরক্ত করবে না!
—না নিয়ে যাও বলছি।
পাখিটা ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, টুকুন চোখ খুলছে। পাখিটা এবারে ভিতরে ঢুকে ফুর ফুর করে উড়তে থাকল। টুকুন ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখল সেই পাখি—সোনার রঙের ঠোঁট, পায়ে সবুজ ঘাসের রঙ, পাখা কালো—গলার নীচে লাল রিবন যেন বাঁধা! টুকুন মনে করতে পারছিল না এই পাখি সে প্রথম কোথায় দেখেছিল। সে পাখিটাকে কোথায় দেখেছে। কবে কখন! এই প্রিয় পাখি কার, কে এই পাখি নিয়ে এসেছিল তার কাছে। যেন স্বপ্নের মতো তার কাছে এক পাখি এসে গেছে, লাল রিবন বাঁধা পাখি! সে এই পাখি দেখে কত দীর্ঘদিন পর যেন মনে করতে পারল—এ পাখি সুবলের পাখি। সুবলকে ফেলে তার কাছে চলে এসেছে। পাখি দেখে টুকুন প্রথম জল খেতে চাইল, জল দিলে সে পাখিটাকে ধরার জন্য হাত তুলতে গিয়ে মনে হল শরীরের ভিতর কী যেন কেবল শির শির করছে। সে সামান্য হাসতে পারল, আরামদায়ক এক অনুভূতি! পাখি, সুবলের পাখি, পাখি যখন এসে গেছে তখন সুবলও এসে যাবে। সুবল, পাখিয়ালা সুবল এই সংসারে এলে আর কোনও দুঃখ থাকবে না। টুকুন সামান্য না হেসে যেন থাকতে পারল না।