জনার্দন খুব পা চালিয়ে হাঁটছিল। সারারাত পাহাড়ের উপর কাজ গেছে। পাহাড়ের মাথা থেকে বড় বড় পাথর ফেলে যোজকের মতো ফাঁকটুকু বন্ধ করে দিচ্ছে। পাগলের প্রায় কাজকর্ম। কী হবে, যদি এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়, যদি নদী জলে ভেসে যায়, এবং পাহাড়ের ভিতর হ্রদের মতো স্থানটুকু জলে ভেসে যায়, তবে কার সাধ্য এই সামান্য আলগা পাথরে আটকে রাখে।
তবু এক বিশ্বাস, এই উপবীতের অহঙ্কার—এর এই কাজ উদ্যম এবং আত্মত্যাগ মন্ত্রের মতো শুভ দিনের জন্য প্রতীক্ষা করবে। জল হবে দেশে, ঘরে ঘরে মানুষজন ফিরে আসবে, সে এই জল নিয়ে চরণামৃত করবে মা সুবচনির, এবং মাঠে মাঠে তাই ছড়িয়ে দিয়ে হাঁকবে, শস্যশ্যামলা দেশে আমার সুবচনি মায়, ছেইলা কোলে লৈয়া বাড়ি বাড়ি যায়। দুর্ভিক্ষ এবং খরার দিনেও জনার্দন প্রায় একটা সুখের স্বপ্ন দেখে ফেলল।
সে দেখল যেন সেই পাহাড়ের ওপর বিরাট এক জলাশয় গড়ে উঠেছে। এক হ্রদ, চারপাশে কত গাছপালা, নীচে কত জীবজন্তু বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। আরও নীচে সমতল মাঠ, কোঠা বাড়ি, ছোট ছোট নালার মতো খাল সমস্ত অঞ্চলটাকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। মানুষ তার প্রয়োজনমতো জল নিচ্ছে নালা থেকে এবং সময়ে শস্য হবে, জলের জন্য শস্য হবে, আর সারা গ্রামময়, অঞ্চলময় কোনও বিষাদ থাকছে না, শুধু গাছপালা পাখি, নদীতে জল, হ্রদে জল, মাঠের মাঝে যেসব খাল হ্রদ থেকে নেমে এসেছে সেখানে জল, আর জলে কত গাছ, মাঠে কত সোনার ফসল, সুবচনি দেবীর মন্দিরে মেলা বসেছে। দূর দেশ থেকে মানুষ এসেছে সওদা করতে, নটুয়া এসেছে গান গাইতে, কবি এসেছে কবিগান শোনাবে বলে। বাজিকর এসেছে জাদু দেখাবে বলে, ছোট—বড় শিশুরা যুবকেরা যুবতীরা মাথায় ফেটি বে�ধে ছুটছে মেলায়, যুবতীরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কাচের চুড়ি কিনছে দু পয়সায় আর মেলার প্রাঙ্গণে বড় নিশান উড়ছে—উদ্যমবিহনে কার পূরে মনোরথ।
জনার্দন বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে নীচে সেই সামান্য জলাশয়ের উদ্দেশ্যে হাঁটছে এবং স্বপ্ন দেখছে। হরিণী আর তার দুই শিশুসন্তান প্রতীক্ষারত। জলের জন্য ওরা দূরের কোনও সংরক্ষিত বন থেকে নেমে আসে। ওরা জলপানের জন্য ভোর রাতের দিকে নেমে আসে এবং ভোরেই জল পান করে চলে যায়। সুতরাং জনার্দন পা চালিয়ে হাঁটছিল। ওর হাতে একটা ছোট পেতলের বালতি, ফেরার পথে সামান্য জল নিয়ে সুবচনির মন্দিরে উঠে যাবে।
ভোরে জলপান করানো তার কাজ, সে নেমে এসে কিছুক্ষণ ওদের তিনজনকে দেখল। হরিণী নির্ভয়ে জিভ বের করে নাক দিয়ে কিছু ঘাম চেটে নিল। হরিণী এতক্ষণ শুয়ে ছিল। জনার্দনকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। পাশে তার দুই শিশু হরিণ ঘোরাফেরা করছে। লাফাচ্ছে। ছুটে দূরে চলে যাচ্ছে। মুখ উঁচু করে কী দেখছে। ফের নেমে আসছে নীচে ঠিক মায়ের কাছে, আর পেটের নীচে এসে গুঁতো মারছে। সামান্য স্তন থেকে দুধ খাবার জন্য মুখ বাড়ালে, এখন নয় এখন নয় এমন ভাব হরিণীর চোখে। সে তার পিছনের দুপা দিয়ে ওদের সরিয়ে দিচ্ছে। তারপর সেই শিশু হরিণেরা মায়ের কাছে বিমুখ হয়ে জনার্দনের পায়ের কাছে দাঁড়াল। জনার্দন ওদের একজনকে তুলে নিল বুকে, অন্যজন মুখ উঁচু করে জনার্দনকে দেখতে থাকল।
—অভিমান। জনার্দন অন্য শিশু হরিণকে বাঁ হাতে তুলে এনে দুগালে দুজনের মুখ লেপ্টে দিল।—কিরে তোদের কি ভয় হয় না। জনার্দন বলল। তোদের মানুষকে এখন ভয় নেই। তোরা এতদূর থেকে চলে আসিস কষ্ট হয় না!
হরিণী তার দুই শিশুর সঙ্গে এই মানুষের ভালোবাসাটুকুতে খুব খুশি, সে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। এবার একেবারে শরীর ঘেঁসে দাঁড়াল। জনার্দন বলল, কতক্ষণ লাগে যেতে? বলে তার কোল থেকে তাদের নামিয়ে দিয়ে বলল, এখন আর লাফানো ঝাপানো নয়। এবার জল খেয়ে সূর্য ভালো করে না উঠতে মানুষের এই অঞ্চল ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আমার অনেক কাজ আছে, ওদিকে মা আমার প্রত্যাশায় বসে থাকে, কেবল কী খাবে কী খাবে করে সারাদিন! জনার্দন তার কথা নালিশের মতো করে যেন ওদের শোনালো, তুই মেয়ে ছেলে খরা এনে দেশটাকে শ্মশান করে দিলি, এখন কেবল খাব খাব করলে চলবে কেন!
ভিতরে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা জনার্দনের। যখন খিদে পায়, যখন পেটের ভিতরটা সামান্য আহারের জন্য ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে তখন পাগলের মতো সুবচনি দেবীর উদ্দেশ্যে গাল পাড়তে থাকে।—খাবি খাবি। সব খেয়ে তোর শান্তি। আমাকেও খাবি। জনার্দন জল খেল। জল খেলে পেটের যন্ত্রণাটা সামান্য সময়ের জন্য কমে যায়।
মন্দিরে আর আহার বলতে কিছু নেই। আলুর লতা এখন পাহাড়ে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জল নিয়ে নদীর পারে সে উঠে এল। হরিণী তার তুই শিশু নিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ের ওপারে যে সংরক্ষিত বন রয়েছে তার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
সে কিছুক্ষণ অপলক ওদের উঠে যাওয়া দেখল। ভিতরে ক্ষুধার কষ্ট, কোনও মৃত পাখি পর্যন্ত সে খুঁজে পেল না, না শুকনো বট ফল। সে ভাবল—দূরে যেসব কুঁড়েঘর রয়েছে, যা এখন শ্মশানপুরীর মতো খা খা করছে—সেখানে উঠে গেলে হয়। ঘরের ভিতরে যদি খুঁজে কিছু সংগ্রহ করতে পারে। যদি কেউ দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় রেখে মারা যায়। জনার্দন এবার মা মা বলে দ্রুত হাঁটতে থাকল। এই অঞ্চল লোকালয়বিহীন। সুতরাং এখন সে প্রায় নগ্ন। সে প্রায় বেঁহুশ। সে ওপরে উঠে যাচ্ছিল, আর বম বম করছিল। মা, তারা শ্মশানীকে বলছিল, তুই মা আর কত কষ্ট দিবি জীবকুলকে এসব বলছিল! মা তারা ব্রহ্মময়ী। ওর চলতে চলতে মনে হল, মা তারা ব্রহ্মময়ী তার সামনে ডাইনির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জীর্ণ কুটিরের দিকে উঠে যেতে বলেছিল। সে বলল, পথ ছাড়। তুই ভেবেছিস ভয় দেখিয়ে আমাকেও দেশছাড়া করবি। তুই জানিস না জনার্দন কত অহঙ্কারী মা। মা তোর একদিন কী আমার একদিন। আমি মা দেখব তোর সন্তানকে তুই আর কত কাল নিরন্ন রাখবি। দেখব, দেখব, দেখব। জনার্দন দ্রুত হাঁটছিল আর তিনসত্য এই বলে গাল দিচ্ছিল, তুই মা করালবদনী, মুখ ব্যাদন করে আছিস, মুখের রক্ত মাটিতে উগলে পড়ছে তবু একবিন্দু জল দিবি না।