রোদের জন্য আকাশের দিকে বেশিক্ষণ চোখ তুলে তাকাতে পারে না সুবল। সে পাখিটার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। ওর এক হাতে বাক্সটা তখন খোলা, অন্য হাতের মুঠোয় সে রোদের ভিতর অনেকটা ঠিক আকবর বাদশার মতো হাতের মুঠোয় পাখি রাখার জন্য গর্বে আত্মহারা। অথবা পাখি উড়ে উড়ে যখন ক্লান্ত হয়, পাখি যখন সুবলের কাছে ফের ফিরে আসে এবং মুঠোয় বসে চারদিক তাকায় তখন সুবলের এক প্রশ্ন, টুকুনদিদিমণিকে পেলি?
পাখি পাখা ঝাপটাল, ফের উড়তে চাইল। সুবল বুঝল, না টুকুন দিদিমণিকে পাখিটা খুঁজে পায়নি। সুতরাং সে বলত, বেশ হয়েছে বাপু, এবার চলো চুপটি করে আমার কাঁধে বসে থাকবে। এখন আর রোদে রোদে তোমায় ঘুরতে হবে না।
এই পাখি যেন সব বোঝে। সুবলের দুঃখের দিনে এ পাখি ছিল, সুখের দিনেও এই পাখি। সে বলল, টুকুনদিদিমণি কোথায় যে গেল।
পাখি বলল, কিচ কিচ। পাখি সুবলের সঙ্গে কথা বলতে চাইল।
সুতরাং সুবলের এখন এক কাজ। টুকুনকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনও ঠিকানা নেই টুকুনের। এতবড় শহর তবু সুবল হার মানল না। সকালের দিকে দুজনের মতো রোজগার হয়ে গেলেই সুবল পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। জানালায় জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে, পার্কের ভিতর ফ্রক পরা মেয়ে দেখলে টুকুনদিদিমণি যদি হয়, সে প্রায় পাগলের মতো এই শহরে টুকুনকে অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে, পার্কে, বড় রাজপথ, গঙ্গার ধারে, এবং বড় বড় বাড়িতে উঠে যেত কাজ নিয়ে। সে কাজের ফাঁকে শুধু কীসের প্রত্যাশা করত যেন।
সুবল ওর পাখিকে পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল অনুসন্ধানের জন্য। যখন ওর শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ত, যখন অবসাদে শরীর চলতে চাইত না, সুবল ওর পাখি ছেড়ে দিত, দেখ যদি তুই কোথাও টুকুনকে খুঁজে পাস। সুবল এক সরল বালক, পাখি এক অবলা জীব, শহরের মানুষেরা সুবলকে দেখলে এবং ওর পাখি দেখলে কৌতুক বোধ করত। সুতরাং সুবল পাখিটার জন্য একটা দাঁড় কিনে নিয়েছে। পাখিটা দাঁড়ে বসে থাকত। সুবল মাঝে মাঝে যখন হাতে কাজ থাকত না আর ঘুরে ঘুরে আর শরীরও যখন দিচ্ছে না, তখন বলত, পাখি তুই আগে ছিলি কার?
পাখি বলত, কী বলত—সরল না হলে বোঝা যায় না, পাখি বলত বুঝি রাজার!
সুবল, মনে মনে এবার বলত, এখন কার?
—এখন তোমার।
—হ্যাঁ তবে দেখ উড়ে, সেই দিদিমণি আমাদের কোথায়! তারপর পাখি উড়তে থাকত। দেওয়ালের পাশে, জানালায়, অথবা সদর পথে এক সোনার পাখি উড়ে যেত। পাখির সরল চোখ জানালায়, ঘরের ভেতর এবং রুগণ যুবক—যুবতী অথবা ছোট মেয়ে দেখলে শিয়রে বসে দেখত সেই টুকুন কিনা। সুবলের পাখি, ভালোবাসার পাখি হয়ে শহরময় উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখি উড়ে উড়ে কত দৃশ্য দেখতে পেল, শহরে বড় লাল বাড়িতে কারা যেন জড়ো হয়েছে, রাস্তায় মানুষের কী ভিড়, আর পুলের উপরে সম্রাট সিজার যেন মিশর দেশ জয় করে ফিরছেন, এক অলৌকিক ঘটনার মতো, পাখি এসে দাঁড়ে বসে গেল এবং কিচ কিচ করে উঠল।
সুবল বলল, পেলি না।
পাখি কিচ কিচ করে উঠল।
—না পেলে আর কী করবি।
সুবল বলল, টেরিটিবাজার থেকে তোর জন্য কীটপতঙ্গ কিনে এনেছি। খা। বলে সুবল দাঁড়ের উপর ছোট পেতলের বাটিতে কীটপতঙ্গগুলো রেখে দিল।
আর তখনই মনে হল শহরের উপর দিয়ে দলে দলে লোক ছুটছে, ওদের কণ্ঠে চিৎকার, অন্ন চাই, বস্ত্র চাই। সুবলের মনে হচ্ছিল ওরা সব বলছে সকলে, শুধু বলছে না, উদ্যম চাই। আমরা কেমন যেন উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, একথা কেউ বলছে না।
সুবলের ইচ্ছা হল চিৎকার করতে, বলুন আপনারা উদ্যম চাই। উদ্যম। উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ। পাঠশালায় জনার্দন ঠাকুর ওদের পড়াত, উদ্যম বিহনে কিবা পূরে মনোরথ।
সুবলের এই করে শহরটা প্রায় ঘোরা হয়ে গেল ক্রমশ। শহরের সর্বত্র সে এক উদ্যমবিহীন জীবন দেখতে পেল যেন। অফিসে, কাছারিতে, মাঠে ময়দানে এবং সব নেতা গোছের মানুষদের মুখেও সব কথার উল্লেখ আছে, শুধু উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, এ—কথা কেউ বলছে না। অফিসে কাছারিতে এবং বড় পার্কের ভিতর মানুষের কথাবার্তা থেকে এসব ধরতে পারত।
সকলের কথায় কী এক আক্রোশ যেন, কেউ সুখী নয়, এত বড় কলকাতা শহর দেখে সে যা ভেবেছিল, সুখের নগরী, দুঃখ নেই, অভাব নেই, জল, অন্ন—বস্ত্র সব কিছু আছে যখন, যখন আলোময় এই শহর, যখন বড় বড় হলঘরের মতো হোটেল ঘর, দেব—দেবীর মন্দির রয়েছে, মানুষের দুঃখ তখন থাকার কথা নয়।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানে শুধু দুঃখই আছে, ফুটপাতে মানুষের দৈন্য, পাগলের প্রাদুর্ভাব বড় বেশি শহরে। এই দুঃখের নগরীতে সুবলের যেন আজকাল আর ভালো লাগছে না। ওর মনে হল সেই সব বরিষের দিন, মাঠে মাঠে ধান, গোয়ালে গোরু, সে গোরু নিয়ে মোষ নিয়ে বের হয়ে গেছে মাঠে, মাঠে মাঠে ফসলের দিনগুলি অথবা আদিগন্ত সবুজ মাঠ শুধু, সে দৌড়ে বেড়াত, মাঠের ভিতর কেবল কী যেন এক রহস্য। গ্রামের অন্য রাখাল বালকের সঙ্গে গুলি খেলা, কোনও বড় অর্জুন গাছের নীচে বসে থাকা, অথবা বুনো মানুষ হরিপদর মুখে—অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভৌতিক গল্প শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যাওয়া—হায় সেই দেশে কী করে এমন খরা এসে মরুভূমির মতো হয়ে গেল, সুবল চোখ বুজে বলল, মা সুবচনি জল দে। যদি জল হয়, যদি খাদ্য হয়, যদি মাঠে মাঠে ফের গোরু মোষ নিয়ে বের হওয়া যায়, কিন্তু কে খবর দেবে, কে বলবে দেশটাতে ফের বর্ষা নেমেছে, দেশটাতে আবার সোনার ফসল ফলবে—কার এমন উদ্যম আছে—ফের মাঠে সোনার ফসল ফলার, বরিষের দিনে জল কোথাও ধরে রাখে, অজন্মা অথবা খরা এলে সেই জলে মানুষ স্নানাহার করবে।
ছয়
পাখি উড়ছিল আকাশে, সুবল ঘুরছিল পথে পথে। টুকুন বসে রয়েছে নিজের জানালায়, আর জনার্দন মাঠ ভেঙে নেমে আসছে। নদীর চোরা স্রোতের ওপর বন থেকে হরিণী ওর দুই বাচ্ছা নিয়ে নিশ্চয়ই এখন অপেক্ষা করছে।