ডাক্তারবাবু বললেন, ওর সে সময় বাসনা, তীব্র বাসনা, বাঁচার তীব্র বাসনা, জীবনের সুখ—সম্পদে কী কোথায় জীবনের তৃষ্ণা রয়েছে সামান্য সময়ের জন্য বোধহয় ভিতরে ওর সেই তৃষ্ণা জেগেছিল। এই তৃষ্ণা কী করে ফের জাগানো যায়। বেঁচে থাকার তৃষ্ণা, রক্তের ভিতরে তুফান, বুঝলেন সুরেশবাবু, সেই তুফানের কথাই বলছি, রক্তের ভিতরে তুফান তুলে দিতে হবে, ঢেউ, যাকে আমরা তরঙ্গ বলি, বেঁচে থাকার জন্য এই তরঙ্গ তুলে দিতে পারলে আবার টুকুনকে বাঁচাতে পারব। সুবল সেই পাখিয়ালা হয়তো সেই রক্তে সামান্য দোলা দিতে পেরেছিল। ডাক্তারবাবু প্রায় সব কথাই বিশেষ করে রুগি সম্পর্কে কথা বলে ইংরেজিতে বলেছিলেন। সুতরাং টুকুন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল, সে স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছে না। সে শুধু বলল, মা, আমি জল খাব।
—সেই এক উদ্যমের কথাই বলছি ডাক্তারবাবু। কথাটা বলে ফের কেমন অন্যমনস্ক হলেন। এবং নিজেকেই নিজে বললেন, আমরা বড় উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি, সুরেশবাবু।
বিকাল মরে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন। সুরেশবাবু এবং টুকুনের মা চলে গেল। নার্স সামান্য দুধ গরম করার জন্য কিচেনের দিকে গেছে। বাইরে আলো জ্বলে উঠল। ঘরে হলুদ রঙের আলো, এখন। এই ঘরের চারপাশে সব পুতুল, জলপরি, স্থলপরি। আর কেউ থাকবে না এখন। সুতরাং পুতুল এবং এইসব পরিরা সন্ধ্যার পর টুকুনের সঙ্গে ঘর—সংসার আরম্ভ করে দেয়। টুকুন আপন মনে কথা বলে চলে, এই রাজ্যে তখন টুকুন রানি অথবা রাজকন্যার মতো। সব পরিদেব, সে জলপরি অথবা স্থলপরি হোক, সে রাজা অথবা কুদুমাসি বিড়ালই হোক টুকুনের কথায় উঠতে বসতে হবে। এদিক ওদিক হলে রক্ষা থাকবে না। পরদিন ভোরে নার্সকে বলবে, মাসি বেড়ালটাকে ঘরের বার করে দাও। সারারাত ওটা আমাকে ঘুমুতে দেয়নি, কেবল জ্বালাতন করেছে।
সুবল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, পাখি তুমি বড় জ্বালাতন করছ। উড়ে গেলে আসতে চাও না।
পাখিটা সুবলের মাথায় মুখে ঘুরতে থাকল। যেন পাখিটা সুবলের অভিমান ধরতে পেরেছে। অভিমান ভাঙানোর জন্য নানাভাবে সুবলকে খুশি করার চেষ্টা করছিল উড়ে উড়ে।
সুবলকে এখন দেখলে প্রায় চেনা যায় না। সে কী করে ইতিমধ্যে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে ফেলেছে। ওর বাঁ হাতে ছোট কাঠের বাক্স, বাক্সের ভিতর জুতোর ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের কালি, ব্রাস, ক্রিম এবং ছোট একটা তোয়ালে। ওর চুল আর বড় নেই, টিকি এখন আরও ছোট করে ছাঁটা। বড় লম্বা জামা আর শরীরে ঢল ঢল করছে না, সুবল প্যান্ট পরেছে একটা, গেঞ্জি গায়ে দিয়ে সমস্ত সকাল জুতা পালিশ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। সে গাছের নীচে শুয়েছিল। পাখিটা ঘাসের ওপর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কিছু চানা কিনে নিজে খেয়েছে, পাখিটাকে খাইয়েছে।
পথের ওপাশে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি। সে ঘাসের উপর শুয়ে বড় সব বাড়ি দেখছিল। জানালায় কত সুন্দর মুখ, সুন্দর মুখ দেখলেই টুকুন দিদিমণির কথা মনে হয়। সে প্রথম ভেবেছিল। কলকাতা গেলেই টুকুনদিদিকে পাওয়া যাবে, সে সেই ডাবয়ালাকে অর্থাৎ সুবল কতদিন সেই ডাবয়ালার ডাব নৌকা থেকে তুলে এনেছে পারে, ডাবয়ালা খুশি হয়ে পয়সা দিয়েছে, তাকে একবার বলেছিল, তুমি জান ডাবয়ালা টুকুনদিদিমণি কোথায় থাকে? লোকটা রাস্তার নাম এবং নম্বর চাইতেই বুঝেছিল সুবল, টুকুনদিদিমণিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, এতবড় শহরে টুকুনদিদিমণি হারিয়ে গেল।
এতবড় শহর দেখে সুবলের বিস্ময়ের আর সীমা ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন জনার্দন চক্রবর্তী ওদের প্রিয় পুরোহিত, গ্রামের এবং অঞ্চলের বাঞ্ছিত পুরুষ যিনি প্রায় সব ধর্মের নিয়ামক তেমন কোনও অসীম এবং অপরিমেয় শক্তিশালী মানুষ, অথবা সে জাদুকর হতে পারে, পির পয়গম্বর হতে পারে যিনি এই শহরকে চালাচ্ছেন। মোড়ে মোড়ে পুলিশ, প্রাসাদে—প্রাসাদে উর্দিপরা দারোয়ান, হাওয়াই গাড়ি, ট্রাম এবং স্রোতের মতো মানুষের মিছিল। সন্ধ্যা হলে রাস্তার সব আলো জ্বলে উঠছে। গাড়িগুলো মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার চলতে শুরু করেছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা পড়ে নেই। কেবল বড় বড় অট্টালিকা আর গম্বুজের মতো রহস্যজনক মিনার সুবলকে বড় বেশি আবেগধর্মী করে তুলেছে।
আর মনে হত এই শহরে টুকুনদিদিমণি আছে। এই শহরের কোথাও না কোথাও টুকুনদিদিমণি আছে। সুতরাং সুবল যখনই সময় পেত, পথ ধরে হেঁটে যেত, গাড়ি দেখলে এবং ফ্রক পরা মেয়ে দেখলে চোখ তুলে তাকাত যদি টুকুনদিদিমণি হয়, যদি টুকুন তার জন্য কোনও জানালায় মুখ বার করে রাখে। সে ভোরের দিকে কাজ করত, সুবল একা মানুষ। কোনও আত্মীয় নেই, বন্ধু—বান্ধবহীন সুবলের আয় থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় হলে সে বাসে উঠতে পারছে, সে ঘুরে ঘুরে কাজ করছে।
সে কখনও এক জায়গায় বসছে না, প্রায় শহরটাই যখন মেলার মতো, প্রায় শহরটাই যখন উৎসবের মতো সেজে আছে এবং যেখানে বসা যায় সেখানেই দু’পয়সা সংগ্রহ হচ্ছে তখন এক জায়গায় বসে কী লাভ। এই ঘোরা, কাজের জন্য ঘোরা এবং টুকুনদিদিমণির জন্য ঘোরা সুবলের একটা বাই হয়ে গেল। শুধু দুপুর হলে সে গড়ের মাঠে চলে আসত। এসময় সুবলের প্রিয় পাখি আকাশে উড়তে চায়। পাখিটা না উড়লে ওর পা স্থবির হয়ে যাবে, পাখি স্থবির হয়ে যাবে ভেবেই সুবল ঠিক দুপুরে, যখন রোদে খা খা করছে সারা মাঠ, যখন দুর্গের উপর কবুতর ওড়ে এবং যখন প্রায় পাখিরা দুপুরের অবসাদে গাছের ডালে অথবা অন্য কোনও ছায়ায় চুপটি মেরে ঠোঁট পালকে গুঁজে পড়ে থাকে তখন সুবল আকাশে পাখিটাকে উড়িয়ে দেয়। পাখিটা উড়তে উড়তে কোথায় যেন চলে যায়। আর দেখা যায় না।