জনার্দন মাঠময় ঘুরে পাহাড়ময় ঘুরে সেই স্থান সেই সংযোগস্থলের সন্ধান খুঁজে পেয়েছিল। সে রাত হলে বড় বড় পাথর গড়িয়ে দিত, নদী এখানে বড় সরু পথ কেটে নেমে গেছে। দু’ধারে পাহাড়, উঁচু মতো পাহাড়, জল নেমে গেলে পাহাড়ের ভিতর হ্রদের মতো জল ধরে রাখবে, শুধু খাদে বড় কিছু পাথর ফেলে দিতে হবে, হাজার পাথর, লক্ষ পাথর। জনার্দন শিশু বয়সের কবিতা আওড়াত—উদ্যমবিহনে কিবা পুরে মনোরথ। শুধু উদ্যম চাই, সফল উদ্যম।
সে একটা পাথর টেনে আনত আর বলত উদ্যম চাই, উদ্যম। মা, মাগো, শক্তি দে। সে আবার পাহাড়ের মাথায় পাথর দোলাত, তারপর পাথরটা নীচে ফেলে দিত, মাগো উদ্যম চাই, উদ্যম। সে সারারাত এক করে ভোরের দিকে হরিণ শিশুদের জলের ব্যবস্থা করে, নিজের জন্য সামান্য জল তুলে সুবচনির মন্দিরে উঠে যেত। ওঠার সময় শুনত, মা—ও যেন বলছেন, উদ্যম চাই জনার্দন, আমরা বড় উদ্যমবিহীন হয়ে পড়েছি।
টুকুনের ঘরেও সেই এক কথা। ডাক্তারবাবু, নার্স, টুকুনের বাবা এবং মা বসেছিলেন। টুকুন এই সময়টাতে একটু হাত—পা মেলে বসার চেষ্টা করে। মা—বাবাকে দেখলে কেমন যেন মনটা নরম হয়। ডাক্তারবাবু ভালোবাসার হাত রাখেন টুকুনের মাথায়।
নার্স টুকুনের বেণী বেঁধে দেবার সময়ে নানারকমের পাখির গল্প করে থাকে। ফুলপরি, জলপরি, স্থলপরি, দেবস্থানে এক রকমের পরি থাকে, ভগবানের কছে অন্যরকমের পরি, আর ডাক্তারবাবু বলছিলেন, সব পাখির এক কথা টুকুন, উদ্যম চাই, বাঁচার উদ্যম। ডাক্তারবাবু টুকুনের বাবাকে বলেছিলেন, মেয়েটার সব উদ্যম শেষ হয়ে গেছে যেন। বেঁচে থাকার স্পৃহা জন্মানো দরকার ওর ভেতরে। নতুবা একদিন শুকিয়ে মেয়েটা কাঠ হয়ে যাবে। কিছুতেই বাঁচানো যাবে না।
সুতরাং এক বাঁচার উদ্যম এই সংসারকে নিয়ত গতিশীল করে রেখেছে। টুকুনের বাবা বললেন, মা, তোমার জন্য আমরা আর কী কী করতে পারি!
টুকুন বলল, বাবা, আমার জন্যে একটা ফুলপরি কিনে আনবে।
বাবা টুকুনকে ফুলপরি এনে দিয়েছিলেন।
টুকুন বলল, বাবা, আমাকে একটা খরগোস কিনে দেবে।
বাবা তাই কিনে দিলেন। আর এভাবেই টুকুনের ঘরটা খেলনায় ভরে গেল। কী নেই এখন টুকুনের ঘরে, জলপরি আছে, ফুলপরি আছে, রাজা আর কুদুমাসি বিড়াল এবং সেই এক বন্দুকধারী সিপাই। টুকুনের বাবা টুকুনের জন্য কোনও অভাব রাখেনি। যা চেয়েছে টুকুন, বাবা সব এনে দিয়েছেন। যেন এখন শুধু টুকুনের জন্য এক রাজপুত্র ধরে আনা বাকি। এনে দিলেই টুকুন এই ঘরের ভিতর স্বর্গরাজ্য তৈরি করে ফেলবে। কারণ টুকুন যেন কী করে জেনে ফেলেছিল—সে মরে যাবে। মরে গেলে মানুষ কী হয়। টুকুনের কী হবে অথবা মৃত্যুর পর টুকুন নিশ্চয় এমন এক স্বর্গীয়রাজ্যের ভিতর প্রবেশ করবে যেখানে তার এই জগৎ থাকবে আর কে থাকবে! সেই সুবল নিশ্চয়ই থাকবে, পাখিয়ালা সুবল, কাঁধে পাখি নিয়ে। বড় পাঁচিল থাকবে একটা, কারণ যারা নরকে যায় তাদের জন্য পাঁচিলের ওপাশে যমপুরী। যমপুরীতে ভূতপ্রেত থাকে। সুবল পাঁচিলের ধারে এসে উঁকি মারলে সে হাত ধরে তাকে তুলে নেবে। তখন বাবা—মা কিছু বলতে পারবে না। সুবল এলেই প্রায় যেন সবকিছু ওর হয়ে যায়। সে হেঁটে চলতে ফিরতে পারবে। সুবলের জন্য তার ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছিল।
টুকুন বলল, বাবা, সুবল বলেছিল কলকাতায় আসবে?
বাবা বললেন, কে সুবল?
—বা, তুমি দ্যাখোনি, ট্রেনে যখন ফিরছিলাম, সেই সুবল, পাখিয়ালা সুবল, আমাদের সঙ্গে আসছিল। মা ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিলেন!
টুকুনের বাবা এতক্ষণে মনে করতে পারল!
ডাক্তারবাবু বললেন, কী ব্যাপার সুরেশবাবু?
—আর বলবেন না। আমরা ফিরছিলাম সিমলা থেকে। ট্রেনটা যখন বাংলায় ঢুকছে, রাতের বেলা, কোথাকার সব কতগুলি লোক, কংকালসার চেহারা, আমাদের ট্রেনটাকে আটকে দিল। বলল, জল চাই, জল চাই। বোধহয় খবরটা পত্রিকায়ও পড়ে থাকবেন।
—হ্যাঁ, সেই খরার খবর! জল নেই নাকি দেশটাতে।
—ওরা ট্রেনে উঠে কল খুলে সব জল খেয়ে নিচ্ছিল।
—তারপর!
—তারপর আর কী! ড্রাইভার ভীষণ চালাক। লোকগুলো সব জল যখন চেটে চেটে খাচ্ছিল, সে মশাই জল খাওয়া দেখলে আপনি ভয় পেয়ে যেতেন, জল এভাবে খায় আমার জানা ছিল না, যেন অমৃত পান করছে অসুরেরা। জলের অপর নাম জীবন, সেদিন ট্রেনে প্রথম বুঝেছিলাম। ড্রাইভার দেখল জলের নেশায় পাগল, ড্রাইভার বুদ্ধি করে ট্রেন সহসা ছেড়ে দিল। ব্যস।
—সব নিয়ে রওনা হলেন?
—হ্যাঁ, প্রায় তাই। দলের মধ্যে সুবল ছিল। সুবল আমাদের কামরায় ছিল! ওর একটা পাখি ছিল সঙ্গে, কিছু কীটপতঙ্গ ছিল, শুকনো বটফল ছিল পুঁটলিতে, সে তার পোষমানা পাখি উড়িয়ে দিয়েছিল, পাখিটা উড়লে টুকুনকে আমরা হাততালি দিতে দেখেছিলাম।
ডাক্তারবাবু বললেন, সে এখন কোথায়?
—জানি না। ব্যান্ডেল স্টেশনে দেখি সে নেই।
টুকুন বলল, মা ওকে নামিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তারবাবু বললেন, আপনারা দেখেছেন টুকুন হাততালি দিয়েছে।
—হ্যাঁ, আমাদের চোখের সামনে।
—তুমি সে কথাটা বলো। টুকুনের মা টুকুন যে স্বপ্ন দেখেছিল তার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
—হ্যাঁ, আর একটা কথা ডাক্তারবাবু, ট্রেনে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সুবল দরজার এককোণায় পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বসেছিল। অন্য স্টেশনে ট্রেন এলে পুলিশ তাড়া করেছিল লোকগুলিকে। সুবল আমাদের কামরায় আছে, টুকুন বলছিল সে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। এটা স্বপ্নের মতো ঘটনা, হয়তো টুকুন স্বপ্ন দেখছে।