টুকুন জানালা থেকে সব দেখতে পাচ্ছে। একটা গাছে কিছু ফুল ফুটে আছে—কী ফুল হবে, বোধহয় নাগেশ্বর ফুল, ফুলের সৌরভ সব পার্কটা কেমন আমোদিত এবং বোধ হয় এই সব ফুলের সৌরভের জন্য নানারকমের পাখি উড়ে এসেছে, পাখিগুলো উড়ছিল, পাতা উড়ছিল, পাখিগুলো উড়ে উড়ে ডালে বসছে, ঠিক যেন সুবলের পাখি! সুবল, এক পাখিওয়ালা সুবল এই শহরে এসে নানা জাতের সব পাখি ছেড়ে দিয়েছে আকাশে।
কিন্তু রাস্তার অন্য দৃশ্য। রাস্তার ওপর বড় মিছিল। মিছিলের আগে একটা মানুষ লাঠি হাতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে একদল মানুষ, ওদের হাতে নানা রঙের ফেস্টুন, ভিন্ন ভিন্ন লেখা, বাঁচার মতো খাদ্য দিতে হবে, চোরাকারবারি বন্ধ করতে হবে, অথবা যেন বলার ইচ্ছা সকলের, আমাদের দাবি মানতে হবে, না মানলে সংসারে সব আগুন লাগিয়ে দেব।
অথবা টুকুন মাঝে মাঝে এমন সব দৃশ্য দেখতে পায় যা মনকে ব্যথিত করে। সামনে একটা—বোধ হয় ওটা শাল—শিমুল জাতীয় গাছ, গাছের নীচে প্রায় উলঙ্গ সব কাচ্চাবাচ্চা, প্রায় নগ্ন সব যুবক— যুবতী রাতে শুয়ে থাকে। ভোর হলেই ওরা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। আর টুকুনের চোখে ঘুম নেই বলে, শেষ রাতের দিকে কেবল মনে হয় ঘোড়ার গাড়িতে অথবা গোরুর গাড়িতে কারা যেন শহরে কেবল কীসব ভোজ্যদ্রব্য নিয়ে আসছে চুরি করে। অথবা মাঝে মাঝে রাত গভীরে শহরের সব অলিগলিতে কীসের যেন ফিসফিস শব্দ, ওরা যেন এক ষড়যন্ত্র করছে।
ভোর হলেই টুকুন দেখতে পায় এক ছোট্ট বালক কাঁধে মই নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে কেবল পোস্টার মেরে যাচ্ছে। ওর একদিন বলতে ইচ্ছা—এই পোস্টারয়ালা, তোমার পোস্টারে কী লেখা আছে?
হয়তো সেই পোস্টারয়ালা জবাব দেবে—কী করে বাঁচতে হয় তার কথা লেখা আছে।
আমার পায়ে শক্তি নেই, আমার শরীর ক্ষীণ হয়ে আসছে, আমি আর বাঁচব না বুঝি। পোস্টারয়ালা, তোমার পোস্টারে আমার বাঁচার কথা লেখা নেই? টুকুনের আরও যেন কীসব প্রশ্ন করার ইচ্ছা। শাল—শিমুলের নীচে যুবক—যুবতীরা কেন রাতে শুয়ে থাকে, অন্ধগলিতে রাতে কারা ফিসফিস করে কথা বলে, কত রকমের ভোজ্যদ্রব্য চুরি যাচ্ছে শহরে, গ্রামে, কেবল মানুষেরা আপন স্বার্থের জন্য সঞ্চয় করে যাচ্ছে, অন্যের জন্য ভাবনা নেই, এমন কেন হয়, টুকুনের ঘুম আসে না রাতে, কেবল দুঃস্বপ্ন।
মা—বাবা বিকালে আসেন, ওঁদের মুখ বড় করুণ, বাবা সারাদিন অফিস করেন, কত হাজার টাকা বাবা রোজগার করেন, বাবা টুকুনের কাছে বীরপুরুষের মতো, মা বাবাকে আদৌ সমীহ করেন না, মা কেমন গোমড়ামুখো অথবা টুকুনকে এই যে নানারকমের খেলনা কিনে দিয়ে যাচ্ছে—গোটা ঘর ভর্তি খেলনা, রাতে ওরা টুকুনের সঙ্গে কেবল কথা বলতে চায়, কিন্তু টুকুন সামান্য তাজা মুখ নিয়ে যখন কথা বলতে থাকে তখন বড় বেড়ালটা মিউ মিউ করে কাঁদে। টুকুনের রাগ হয়। তুমি কাঁদবে না, কাঁদলে তোমাকে বাছা জলে ফেলে দেব।
গোটা ঘর ভর্তি খেলনা। টুকুনের মাঝে মাঝে মনে হয় খেলনাগুলো সব নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। হাসি—মশকরা করছে। যেন টুকুনই এখন ওদের খেলনা হয়ে গেছে। কারণ টুকুন বিছানা ছেড়ে ওদের কাছে যেতে পারে না, হাঁটতে পারে না। দিনের বেলায় শুধু জানালা দিয়ে সামনের মাঠ দেখে, এবং মাঠ, গাছ, পাখি আর পথের বিচিত্র সব মানুষদের দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যায়। ওর তখন সব ছেড়েছুড়ে ছুটতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু হায়, পায়ে একেবারে শক্তি পাচ্ছে না। হায়, সেই পাখিয়ালা যে টুকুনকে হাসিয়েছিল, যার জন্য টুকুন তালি বাজিয়েছিল এবং যে মানুষের জন্য টুকুন দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পেরেছিল, সেই মানুষের আর দেখা নেই।
টুকুনের বাঁ—দিকে বড় একটা পুতুল ছিল, টুকুন দেখল পুতুলটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। সামান্য গোঁফের রেখা আছে পুতুলটার মুখে, পুতুলটার নামও আছে একটা, টুকুন চিৎকার করে উঠল, রাজা, এক থাপপর মারব। খুব হাসা হচ্ছে! সব খেলনাগুলো ভয়ে যেন কাঠ হয়ে গেল।
টুকুন সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বালিশের নীচ থেকে চন্দনের বিচি, পাথর এবং কুঁচ ফল বের করে দেখাল রাজাকে এবং অন্যান্য পুতুলগুলিও ওর দিকে যেন চন্দনের বিচি, লাল—নীল পাথর, কুঁচ ফল দেখার জন্য এগিয়ে এল। টুকুন এবার বলল, বুঝলি রাজা আমি মিথ্যা বলি না। এই দেখ, সুবল আমাকে কত কিছু দিয়েছে। সুবলকে পুলিশ ধরতে এসেছিল, আমি নিজে পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে রাজা এবং কুদুমাসি বিড়াল সকলের হয়ে আদাব দিল টুকুনকে। তারপর টুকুন তাচ্ছিল্যভরে ওদের শোনাল, দেখিস সুবল এলে আমি তোদের হেঁটে দেখাব। সুবল জাদুকর, সে জাদুর পাখি রেখেছে কাঁধে। সে পাখি উড়িয়ে দিলেই আমি তোদের কাছে হেঁটে চলে যেতে পারব।
পাঁচ
সেই এক জাদুকরের জন্য জনার্দন চক্রবর্তীও ঘুরছে। একা নিঃসঙ্গ মাঠে জনার্দন চক্রবর্তী রাতের অন্ধকারে অথবা ভোররাতের দিকে ঘুরছে। খরা থেকে এই মাটিকে রক্ষা করার জন্য ঘুরছে। এক প্রচণ্ড অহমিকা জনার্দনের। সুবচনি দেবীর মন্দিরে মাথা কুটছে, মা জল দাও। জল দাও। মা, জলে তুমি মাটি ভাসিয়ে দাও। মা, তোমার সন্তানেরা সব দেশ ছেড়ে চলে গেল। কেউ আর ফিরে এল না, আমি মরে গেলে তোকে কে আর ফুল জল দেবে। কিন্তু নিষ্ঠুর সুবচনি দেবী, করালবদনি ডাইনি মুখ ব্যাদান করে আছে। লম্বা জিভে যেন জনার্দনকে ভেংচি কাটছে। শ্মশানের মতো মন্দিরের চারপাশে শুধু আগুনের মতো রোদ।