তখন চেকারবাবু ডাকলেন, এই ছোকরা, ওখানে কী হচ্ছে। টিকিট কোথায়?
—বাবু টিকিট নেই।
চেকারবাবু দেখলেন সুবলকে এবং চেহারা দেখে না হেসে পারলেন না। ভিখারির মতো জামাকাপড় গায়ে কতরকমের পোঁটলা ঝুলছে কাঁধে, হাতে লাঠি এবং পিঠে বাঁশের চোঙ। একেবারে বহুরূপী।
অন্য চেকারবাবু বললেন, ঠিক শালা খরা অঞ্চলের লোক। উপদ্রব বাড়ছে।
—কী করে হবে! ওরা তো দল বেঁধে আসছে। এ তো একা।
—দল ছুট। দেখে বুঝতে পারছ না?
সুবল দেখল বাবু দু’জন ওকে দেখে খুব হাসাহাসি করছে। সুবল যেন সাহস পেল এবার। কাছে গিয়ে বলল, বাবু আমাকে ছেড়ে দিন। আমার পয়সা নেই। এই দেখুন বলে সে তার জেব উলটে দেখাতে গেলে পাখিটা উড়ে এসে ওর মাথার ওপর বসল। আর সঙ্গে সঙ্গে চেকারবাবু দু’জন বলল, শালা ভোজবাজি জানে। জেব উলটে পয়সা নেই দেখাতে গেল আর শালার জেব থেকে পাখি উড়ে এসে মাথায় বসল। পয়সার বদলে পাখি!
চেকারবাবু বললেন, খুব তো ভোজবাজি শিখেছ।
—না কর্তা। কোনও ভোজবাজি নেই। পাখি আমার পোষা। ও জেবের ভিতর থাকে। খুব নাছোড়বান্দা না হলে চোঙের ভিতর ভরে রাখি না। বলে সে পিঠ থেকে বাঁশের চোঙা এনে উলটে দেখাল। তারপর একটু হেসে খুব বিনীতভাবে বলল, যাব কর্তা? শুকনো বটফল ছিল পোঁটলাতে, কথা বলতে বলতে দুটো একটা বটফল মুখে পুরে দিচ্ছিল।
এখন যথার্থই যেন সুবলের কোনও ভয় ছিল না। কোনও ডর ছিল না। চেকারবাবুরা ওকে কোনও আর ভয়ও দেখাচ্ছে না, কেমন আলগা করে পথ ছেড়ে দিলেন। সুবল পাখির খেলা দেখানোর জন্য চেকারবাবু দু’জন বোধহয় খুশি। সে প্রায় চুপি চুপি বের হয়ে সোজা স্টেশনের কাউন্টার পর্যন্ত হেঁটে এল। প্রায় মুক্ত এখন সুবল। সে ঘুরে ফিরে এতবড় স্টেশন দেখতে থাকল। চারদিকের এই প্রাচুর্য ওকে জীবনযাপন সম্পর্কে আর কোনও ভয়ের উদ্রেক করতে পারল না। যখন এত প্রাচুর্য, এত জল আর এত সুখী মানুষের ভিড় তখন সামান্য এক সুবলের আহারের জন্য ভাবনা কী। সে প্রায় লাফিয়ে হাঁটতে থাকল, ঘুরতে থাকল এবং ছবির মতো, রাজারানির মতো আর নদীর জলের মতো পরিচ্ছন্ন এই স্টেশনের চারদিকটা দেখতে পেয়ে সে আনন্দে প্রায় শিস দিয়ে উঠল।
কোনও গ্রাম্য সংগীত ও শিসে বাজাচ্ছিল। আর ওর মুখের শিস শুনে পাখি পর্যন্ত আত্মহারা। পাখি এবং সুবল এমন একটা দেশে চলে এসেছে—এমন প্রাচুর্যের দেশ, ভাবল সে। বাইরে বের হতেই দেখল বড় বড় দোতলা সব বাসগাড়ি, ট্রামগাড়ি দৈত্যের মতো—সেই যেন আলাদীনের প্রদীপ, যা চাওয়া তাই পাওয়া যায়। আলাদীনের পোষা দৈত্যের মতো সব ট্রামগাড়ি, বাসগাড়ি সুবলের জন্য এবং ওর পাখির জন্য প্রতীক্ষা করছে। সুবল বলল, রোস। আমরা আসছি। কারণ ডানদিকে কিছুদূর হেঁটে গেলে জল, টিপকল থেকে কেবল জল পড়ছে।
সে জলের নীচে ফের ছুটে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিকে জল খাওয়াল, স্নান করাল। এবং শান্তশিষ্ট বালকের মতো সে তার ভিজা নেংটি কাপড়, জামা সব রেলিঙ—এ শুকোতে দিলে।
এখন নদীর জলের ওপর সব বড় জাহাজ ভাসছে, কোথাও আকাশের নীচে লম্বা ম্যাচ বাক্সের মতো বাড়ি, ডানদিকে বড় একটা পুল, মাথায় সারি সারি সব পাখি বসে রয়েছে আর সব ঠেলাগাড়িতে আলু, ফুলকপি, শাকসবজি হরেক রকমের কত তরমুজ এবং ফল যাচ্ছে। সে অপলক দেখতে দেখতে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতের কথা ভাবল। তিনি সামান্য জলের জন্য কী না করেছেন। পাগলের মতো পাহাড়ের নীচে, সমতলভূমিতে, নদীর ঢালু অঞ্চলে এবং পাহাড়ের গিরিপথে জলের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। হায়, যদি মানুষরা কলকাতার এত প্রাচুর্যের কথা জানতে পারত। তা হলে বুঝি তিনি সব ফেলে, তাঁর সুবচনি মন্দিরে তেলসিঁদুর ধান—দূর্বা ফেলে এখানে চলে আসতেন।
ঠিক তক্ষুনি এক বৃদ্ধ যেন সেই জনার্দন চক্রবর্তী, সে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল—না, জনার্দন ঠাকুর নয়, অন্য মানুষ, তেমনি লম্বা জোয়ান মানুষ, মাথায় সাদা চুল, চোখ বড় বড়, পায়ে হরেক রকমের রঙবেরঙের কানি বাঁধা, হাতে পায়ে গলায়! ঠিক ফকির দরবেশের মতো মুখ—কেবল হেঁকে যাচ্ছে। কী হাঁকছিল বোঝা যাচ্ছে না—খুব সন্তর্পণে কান পাতলে ওর অস্পষ্ট কথা ধরা যাচ্ছে। সে দু’হাত ওপরে তুলে নাচছিল, গাইছিল এবং মাঝে মাঝে কলকাতা শহরকে যেন সে জরিপ করছে—একটা ফিতা ছিল হাতে, সে ফিতা দিয়ে কী যেন কেবল মাপছে মাঝে মাঝে। সুবল বুঝল মানুষটা তবে জনার্দন চক্রবর্তী নয়। সুবল রেলিং থেকে ওর জামাকাপড় তুলে নিল। তারপর এক অনির্দিষ্ট যাত্রা। এই শহর এতবড় শহর ঘুরে ঘুরে দেখা। কিছু আহারের ব্যবস্থা করতে হয়। সুবল আহার সংস্থানের নিমিত্ত চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটতে থাকল।
তখন টুকুন হাসপাতালের এক ঘরে শুয়ে ছিল। জানালার পাশে টুকুনের বিছানা। স্প্রিং—এর খাট। মাথার দিকটা একটু ওপরের দিকে তোলা। টুকুন সামনের জানালা দিয়ে মাঠ দেখতে পাচ্ছিল। জানালার নীচে পথ, পথের ওপর এক ফুচকাওয়ালা ফুচকা বিক্রি করছে। বড় গরম চারিদিকে। বৃষ্টি নেই, টুকুন গরমে হাঁসফাঁস করছিল দুপুর থেকে।
এখন বিকেল সুতরাং এখন ফুচকাওয়ালা ফুচকা নিয়ে বের হয়েছে। এখন বিকেল সুতরাং মাঠে মাঠে খেলার দৃশ্য আর পার্কের ভিতরে ছোট বড় ছেলেমেয়ে সব খেলতে এসেছে। ওরা ঘাসের ওপর ছুটাছুটি করছিল।