কিন্তু একজন নীল উর্দিপরা লোক এসে হেঁকে উঠতেই সে ভয়ে ভয়ে কলের নীচ থেকে বের হয়ে গা—শরীর মুছে যখন প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছিল তখনও ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। জেবের ভিতর পাখিটা আছে কিনা দেখে নিল সুবল, তারপর ছুটে গিয়ে সেই কামরার জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁকল, টুকুন দিদিমণি, আমি স্নানটা সেরে নিলাম।
সুবলের মুখ কী সতেজ, আর কী এক গ্রাম্য সরলতা—আশ্চর্য সরল চোখ সুবলের। স্নান করার জন্য চুল থেকে এখনও টুপটাপ জলের ফোঁটা মুখে শরীরে পড়ছে। সেই লম্বা জামা গায়ে, পোঁটলাপুঁটলি কাঁধের দু’ধারে ঝোলানো—প্রায় তীর্থযাত্রীর মতো দেখতে। একটা শুকনো ডাল হাতে এবং বাঁশের চোঙটা পিঠের ডানদিকে ঝুলছিল।
টুকুন ওর সরল গ্রাম্য চোখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, সুবল, তুমি কলকাতায় গেলে আমাদের বাড়ি এসো।
—যাব দিদিমণি।
—তোমার পাখিটা কোথায় সুবল?
—পাখিটা জেবের ভিতর বটফল খাচ্ছে দিদিমণি।
—তোমার পাখিটা আর একবার উড়বে না?
—উড়বে না কেন? বলে সে হাত দিল পকেটে। তারপর পাখিটাকে কাঁধে বসিয়ে দিল। তারপর এই প্ল্যাটফর্মে পাখিটা সুবলের মাথার চারপাশে ঘুরে ঘুরে জেবের ভিতর ঢুকে গেল।
টুকুন বলল, তুমি আমাদের বাড়িতে গেলে আমি আবার পাখির খেলা দেখব। বলতেই ট্রেন—টা ছেড়ে দিল। সুবল গাড়িটার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গেল। সুবল, টুকুন দিদিমণিকে একটা চন্দনের বীচি, একটি পাথর এবং সেই দুর্মূল্য কুঁচফল দেবে ভেবেছিল, এত তাড়াতাড়ি ট্রেন ছেড়ে দেবে তার মনে হয়নি। সে পোঁটলা খুলে দিতে গিয়ে দেখল ট্রেনটা সামান্য চলছে। সে পোঁটলা থেকে চন্দনের বীচি একটি পাথর ও সেই দুর্মূল্য কুঁচফল বের করে গাড়ির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টুকুনের হাতে দিল। সে দাঁড়িয়ে থাকল। চারদিকে অপরিচিতি জন, পাখিটা জেবের ভিতর খুঁটে খুঁটে কেবল ছোলা খাচ্ছে, আর একটা ট্রেন এসে এই মাত্র থামল প্ল্যাটফর্মে। সব মানুষেরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামছে কিন্তু বড় নির্জন মনে হল জায়গাটা। যেন সেই পরিত্যক্ত মাঠ এবং পাহাড়ের মতো এই প্ল্যাটফর্মে শুধু হাহাকারের দৃশ্য। কোথাকার একটা ট্রেন তার প্রিয় দিদিমণিকে নিয়ে চলে গেল।
সুবলের দীর্ঘদিন পর আজ মা’র কথা মনে হল। মেলার কথা মনে হল। সুবচনি দেবীর মন্দিরে ফসল ঘরে এনে যে উৎসব হত তার কথা মনে হল—সে মেলায় বিদেশ থেকে কত লোক আসত, বাজিকর আসত, সাপের পেটে মানুষের মুখ, একটা মানুষের তিনটে মুখ, তিনটে মানুষের একটা মুখ, বড় বড় কাচের বৈয়াম, আর তার ভিতর কিম্ভূতকিমাকার সব মানুষ, অথবা মাঠের শেষ দিকে বড় তাঁবু, সার্কাসের খেলা, হাতি, বাঘ, সিংহ, একটা মেয়ে তারে ঝুলে খেলা দেখাত। একটা ট্রেন গাড়ি তার টুকুন দিদিমণিকে নিয়ে চলে গেল—এসব দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকল সুবলের। আর একটা ট্রেন এসে থেমেছে। ট্রেন চলে যাবে এবার। সুবল ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে বসে ওর পোঁটলাগুলো ফের বেঁধে নিল। তারপর যাকে সামনে পেল তাকেই শুধাল, এই ট্রেন কর্তা, কলকাতা যাবে না?
কে যেন বলল, যাবে।
সে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনে উঠে গেল। ট্রেনটা নীল রঙের। বড় হাতল ঝুলছে। সুবল বয়েস অনুযায়ী লম্বা এবং পায়ের পেশী পাহাড়ে ওঠানামার জন্য বড় শক্ত। সে এক পাশে ভিড়ের ভিতর একটা হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন আর মনে কোনও গ্লানি নেই। ট্রেনটা ওকে কলকাতা নিয়ে গেলে সে টুকুন দিদিমণির কাছে চলে যেতে পারবে।
আর এ—সময়ই সুবলের মনে হল ভীষণ ক্ষুধা পেটে। সে তার সঙ্গের শুকনো বটফল থেকে একটা দুটো করে মুখে পুরে দিতে থাকল। সে বটফল চিবুচ্ছে আর দু’পাশের বড় বড় কলকারখানা দেখে কেবল বিস্মিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও এক রাজার দেশে চলে এসেছে। যেন এখানে অন্নের অভাব নেই। অন্ন চাইলেই অন্ন। জলের অভাব নেই, জল চাইলেই জল। আর ভালোবাসার অভাব নেই, টুকুন দিদিমণি রাজ্যের সব ভালোবাসা তার জন্য সঞ্চয় করে রেখেছে। তার মনে হল, কলকাতায় পা দিলেই সে রাজা বনে যাবে।
সুবল দেখল তার গাড়ি আশ্চর্য এক নগরীর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। সে চোখ মেলে যত দেখছে তত বিস্মিত হচ্ছে। বড় আশ্চর্য এক নগরী, চারিদিকে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি, সেই সুসনের রাজবাড়ির মতো, কবে একবার বাবা তাকে রাজবাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, কবে একবার সে ছোট বেলায় গল্পের বইয়ে রাজবাড়ির গল্প পড়েছিল, চারিদিকে বড় বড় অট্টালিকা, চারিদিকে বাঁধানো রাস্তা। বড় বড় দেবদারু গাছ, গাছে গাছে রুপোর পাতা, সোনার ফল, নীচে বনের ভিতর সোনার হরিণ—এ যেন সেই রাজার দেশ, লাইনের ওপর তার, আর আশ্চর্য এক লম্বা ঘরের ভিতর তার গাড়ি ঢুকে গেছে, নানারকমের নীল লাল রঙের বাতি, বেগুনি রঙের বাতি, কত হাজার হাজার লোক, সব রাজবাড়ির রাজপুত্রদের মতো ফিটফাট, কোথাও কোনও অপরিচ্ছন্নতা নেই, ঝক ঝক করছে সবকিছু।
অথচ কেউ দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত গল্প করছে না, সকলে নিজের মতো হেঁটে যাচ্ছে। সকলে ব্যস্ত। সকলে যেন কোথাও কোনও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছে। অথবা কোথাও বড় এক রাজবাড়ি আছে, সকলে সেই রাজবাড়ির উদ্দেশে ছুটছে।
সুবল ভিড়ের ভিতর দেখল ডান পাশের লোহার গেটে চেকারবাবু কার সঙ্গে পয়সার হিসাব করছেন গোপনে, মনে হল, চেকারবাবুর হাতে কে পয়সা গুঁজে দিল। সুবল দাঁড়িয়ে থাকল। ওর কাছে পয়সা নেই, টিকিট নেই। এখন টুকুন দিদিমণি নেই যে ওকে গেট পার করে দেবে। এই লোহার দরজাটার কাছে এসেই সুবলের ভয়ে পা সরছিল না। সে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, ভিড় কমলে চেকারবাবুকে বলবে, বাবু আমার পয়সা নেই, আমার কিছু বটফল আছে, কিছু পাথর আছে আর আছে এক পাখি। আমি বাবু আমার পাখির খেলা দেখাতে পারি। বাবু পাখির খেলা দেখলে আপনি খুশি হবেন। খুশি হলে বাবু ওকে ছেড়ে দেবে এই ভেবে সুবল একটু পিছনের দিকে সরে তাকাতেই দেখল—ট্রেন, মেলা ট্রেন, কেবল ভোঁস ভোঁস করছে ট্রেন। মানুষ আর লটবহর চারিদিকে। লোহার রেলিং পার হলে ফলের দোকান। চারিদিকে এত প্রাচুর্য, এত সম্পদ, এত মানুষ, এত জল—সুবল ক্রমশ কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ছে।