জনার্দন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকলেন। ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ, ঘরের ভিতর একটা ছেঁড়া বালিশ—তিনি তার ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। দিনের বেলাতে আর বের হওয়া যাবে না বোধ হয়, চারিদিকে লু বইছে। মাথায় মুখে কাপড় জড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। তিনি স্থির করলেন, দিনের বেলাতে সুবচনির মন্দিরে নিদ্রা যাবেন, রাতের বেলাতে উঠে খাদ্য অন্বেষণ এবং অন্যান্য কাজ, কী করে এই মাটিকে উর্বর করা যায়, কী করে ফের মন্ত্রের অমোঘ শক্তিতে বৃষ্টিপাত ঘটানো যায়, সে সবের চেষ্টা।
কারণ জনার্দন ঠাকুরের মন্ত্রের ওপর জনগণের বড় বিশ্বাস ছিল। এই অঞ্চলের দেবী সুবচনি, এই অঞ্চলের রক্ষার দায়িত্ব তাঁর। আর জনার্দন ঠাকুর পুরুষানুক্রমিক দেবীর সেবাইত। পুরুষানুক্রমিক বিশ্বাস, অঞ্চলের মানুষদের বিষয় সম্পর্কে জনার্দন ঠাকুর—প্রায় যেন ঈশ্বরের কাছের মানুষ। অশিক্ষিত গ্রাম্য এবং পূর্ণিয়া অথবা বিহার—বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ এরা। কিছু পাহাড়ি আদিবাসী। কিছু বাঙালি। ভাষা, বিহার—বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের। বড় গরিব মানুষগুলো। যা ফসল ফলত মাঠে, ওরা সোনার ফসল ভেবে নিত। এভাবে ওদের বছরের পর বছর কেটে গেছে। জলের কষ্ট ছিল, কিন্তু জলের অভাবে গোরু—বাছুর মরে যায়নি, অন্নের কষ্ট ছিল মানুষের—কিন্তু কেউ অনাহারে থাকে না। মা সুবচনি, বড় জাগ্রত, বড় লক্ষ্য তাঁর সন্তানের ওপর।
বিস্তীর্ণ পাহাড় আছে, শাল—শিমুলের গাছ আছে, বনে পাখি আছে, হরিণ আছে, আর কত রকমের মূল আছে গাছের যা তুলে ক্ষুধায় খেলে অন্নকষ্ট দূর হয়, শরীরে শক্তি সঞ্চার হয়। গৃহস্থের সোনার ফসল, গরিবের মুনিষ খেটে খাওয়া, কাজ না থাকলে, বনে—পাহাড়ে ঘুরে বেড়াও সকল অন্নকষ্ট দূর হয়ে যাবে। তেমন অঞ্চলে পর পর তিন বছর খরা গেল—সকলে দুঃস্বপ্ন দেখল—বুঝি এই অঞ্চল মরুভূমি গ্রাস করে নিচ্ছে।
সুতরাং মানুষেরা যাদের সহায়—সম্বল আছে তারা শহরে চলে গেল, মড়কে কিছু লোক সাফ হয়ে গেল আর বাকি যারা ছিল এতদিন তাদের জনার্দন ঠাকুর নানারকম আশ্বাস দিয়ে ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু হায়, কোথাকার এক ট্রেন এসে তাদেরও নিয়ে চলে গেল। জনার্দন দুঃখে হতাশায় ভেঙে পড়লেন। তবু হায়, জনার্দন ঠাকুরের এই মাটির জন্য আশ্চর্য এক ভালোবাসা। এমন মাটি, ভালোবাসার মাটি, কোথাও যেন তাঁর নেই। তিনি এখানে রাজার মতো ছিলেন, মানুষের কাছে তিনি এখানে পিরের মতো। সেই মানুষেরা চলে গেছে। সেই সব ভালোবাসার মানুষেরা চলে গেছে। তিনি তাদের আর কিছুতেই বুঝি ফেরাতে পারবেন না। তাঁর বাপ—পিতামহের গল্প, দেবীর সব পৌরাণিক ইতিহাস, এবং যা চমকপ্রদ, ঈশ্বরপ্রাপ্তির প্রবাদ এই মাটির সঙ্গে মিশে আছে। কেউ আর স্মরণ করবে না, জনার্দন ঠাকুরের পরিবার দশ পুরুষ আগে পূর্ববাংলার কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে এখানে সুবচনি দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন এত লোকালয় ছিল না, দেবীর আশীর্বাদ পাবার লোভে মানুষেরা এই পাহাড়ের নীচে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর থেকে এই জনার্দন এবং তাঁর পরিবার পৌরাণিক ধর্ম বিশ্বাসের মত।
জনার্দন ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে ফের উপবীতে হাত রেখে বিড় বিড় করে কী যেন আওড়ালেন, যেন তিনি শপথ করছেন। কীসের শপথ স্পষ্ট বোঝা গেল না। তবু তাঁকে দেখলে মনে হল আমৃত্যু এই মাটির সঙ্গে তাঁর লড়াই। দেবীর সঙ্গে তাঁর লড়াই। ঊষর এই দেশকে উর্বর করে তোলার জন্য তাঁর সংগ্রামকে বড় স্বাস্থ্যকর মনে হবে। কিন্তু তাঁর মুখের ছবি, চোখের দৃঢ়তা এবং উপবীতের অহঙ্কার তাঁকে যেন বড় এক লম্বা দৈত্যের মতো বড় করে ফেলেছে! ভয়ঙ্কর খরা, বাইরের লু আর ঊষর প্রকৃতি তাঁকে নিরস্ত করতে পারল না।
শরীর—মন—প্রাণ শক্ত করার জন্য তিনি বিড়বিড় করে দেবী সুবচনির পাঁচালি পড়তে থাকলেন, সুবচনি মায় বাড়ি বাড়ি যায়, বাড়ি বাড়ি গেলে মায় আমার ধান্য—দূর্বা পায়। আরও কী বলার ইচ্ছা যেন। যেন বলার ইচ্ছা মা, তোর এত ছেলে আছে, আর তুই তোর মাটির ছেলেদের সব একসঙ্গে গ্রাস করে ফেললি! জনার্দন চিৎকার করে উঠলেন, সুবচনি মায়গ আমার বড় দয়াময়, ছেলে কোলে লইয়া ঘোরে পাড়াময়। জনার্দন আবছা অন্ধকারের ভিতর উঠে বসলেন, বললেন, তুই যদি দয়াময়ী হস মা, তবে তোর এই রাক্ষুসী মুখ দেখতে পাচ্ছি কেন?
তখন সারা মাঠ খা খা করছিল। চিতার মতো জ্বলছে গ্রাম—মাঠ গাছগাছালি। জনার্দন পরিত্যক্ত এক কুঁড়েঘরে বসে আছেন। তিনি ভিজা আলখাল্লাটা গায়ের ওপর রেখে দিয়েছিলেন, এখন সেই আলখাল্লা এবং কাপড় দুই—ই শুকিয়ে প্রায় শক্ত কাঠ।
তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বিশ—ত্রিশ ক্রোশ হেঁটে শহরের দিকে চলে যাবেন—কিন্তু যা খবর সেখানেও লোক নেই। লোক সব শহর—গঞ্জ ছেড়ে দিচ্ছে। সরকার থেকে যা সামান্য সাহায্য আসছে তাও বন্ধ। সরকার থেকে যে পাতকুয়া গ্রামের মাঠে কাটা হয়েছিল, তাতে জল নেই। সুতরাং জনার্দন ক্রমশ ভেঙে পড়ছেন। ওঁর প্রবল আবেগ, ঊষর জমি উর্বর করে তোলার আবেগ ক্রমশ মরে যাচ্ছিল। কারণ সর্বত্র এই হাহাকারের দৃশ্য—জনার্দন এবার পাগলের মতো দরজা খুলে দিলেন এবং তপ্ত মাঠের ওপর দিয়ে লু—এর ভিতর দিয়ে শ্মশানের মতো এক সাম্রাজ্য শুধু চারিদিকে—জনার্দন চোখ—মুখ বন্ধ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে ছুটছেন।
চার
তখন ট্রেনটা ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে ছাড়ব ছাড়ব করছে। সুবল কামরা থেকে নেমে গিয়েছিল, নেমে গিয়ে দেখল বড় একটা চোঙ দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে যেন জল পড়ছে। এত জল! সে অবাক হয়ে তাকাল পশ্চিমের দিকে, সেখানেও বড় একটা চোঙ থেকে জল পড়ছে আকাশ থেকে। এত জল। সুবল দেখল নীচে ছোট ছোট টিপকল, কেবল জল আর জল। সে তাড়াতাড়ি পোঁটলাপুঁটলি রেখে জলে স্নান করে নিল। জল আর জল। চোখ—মুখে জল পড়তেই শরীরের সব অবসাদ কেটে গেল। যেন সমস্ত শরীরে ঈশ্বর তাঁর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ দিচ্ছেন। সে কলের নীচে শুয়ে বসে লাফিয়ে স্নান করল। ওঃ, কী ঠান্ডা জল! ওঃ কী আরাম!