তিনি যত এগুচ্ছিলেন তত এইসব ছোট ছোট প্রাণীগুলোকে কেমন চঞ্চল দেখাচ্ছিল। কাছে গেলে বুঝতে পারলেন দুটো হরিণ শিশু জলের জন্য পাশের সংরক্ষিত বন থেকে এখানে ছুটে এসেছে। ওঁকে দেখে তারা ছুটে পালাল না! শুধু সামান্য লাফ দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল। তিনি গর্তের পাশে দাঁড়ালে আরও বিস্মিত হলেন—একটা বড় হরিণ গর্তের ভিতর পড়ে গেছে, হরিণটার হাঁটু পর্যন্ত জল, সে তার শিশুদের জল দেবার জন্য নীচে লাফিয়ে পড়েছে। আর উঠতে পারছে না। কেবল ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃদ্ধকে দেখে কেমন কঁকিয়ে কঁকিয়ে একটু শব্দ করল তারপর বৃদ্ধকে অপলক দেখতে থাকল।
তিনি এবার হরিণ শিশুদের অতিক্রম করে সেই গর্তে নেমে গেলেন। নীচে নেমে হরিণটাকে পাড়ে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর আলখাল্লাটা জলে ভেজালেন। হরিণী একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাচ্চাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছে। জলের পিপাসা ওদের এত বেশি যে, ওরা জল খাবার জন্য ঝুঁকে পড়ছিল গর্তে। প্রাণের মায়া ছিল না। বৃদ্ধ আলখাল্লা ভিজিয়ে জল তুলে আনলেন। একটু একটু করে তিনি সেই তিনটি শিশুকে আলখাল্লা চিপে জল খেতে দিলেন। ওরা জল খেল, লাফাল, তারপর হরিণীর সঙ্গে সেই বনের দিকে ছুটে যাবার জন্য পাহাড়ের কোলে উঠে গেল।
যতক্ষণ না ওরা তিনজন হারিয়ে গেল ততক্ষণ বৃদ্ধ সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এখন আর যেন কিছু করণীয় নেই। বালির নীচে চোরা স্রোত, এই স্রোতের সন্ধান যদি তিনি গতকাল পেতেন তবে বুঝি এইসব অঞ্চলের অন্তত কিছু কিছু মানুষকে শস্য এবং সুদিনের আশ্বাস দিয়ে ধরে রাখতে পারতেন। কিন্তু হায়, ওরা এখন সব বিবাগী। ওদের ছোট ছোট কুঁড়েঘর পড়ে আছে। পাহাড়ি উপত্যকাতে এই সময় অন্যান্য বছর যখন বর্ষার জলে মাটি ভিজতে থাকে তখন এক মেলা হয়, উৎসব হয়, উৎসবে তিনি প্রধান মানুষ। এই উৎসব শস্যের জন্য, সম্পদের জন্য, কতকাল থেকে পৈতৃক এই ব্যবসা তাঁর। সকলের বিশ্বাস এখন তিনিই একমাত্র মানুষ যার মন্ত্রের উচ্চারণে আর তেমন শক্তি নেই। হোমে তিনি যে বিল্বপত্র দান করেন এখন তা আর তেমন পবিত্র নয়—নিশ্চয় কোথাও না কোথাও তিনি তাঁর পবিত্র জীবন থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। মানুষের বিশ্বাসভঙ্গের দায়ভাগ তাঁর ওপর।
বৃদ্ধ পুরোহিতের নাম জনার্দন চক্রবর্তী। তিনি জলের ভিতর তাঁর মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন। চোখে—মুখে অবসাদ, বড় বড় দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে, তিনি ক্রমশ কেমন বন্য জীবের মতো হয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে বনমানুষের মতো মনে হচ্ছে। তিনি রোদের জন্য ওপরে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তিনি উলঙ্গ হলেন এবং হাঁটুজলে নেমে শরীরে মুখে জল ঢেলে দিলেন। সমস্ত ক্লান্তি এবং অবসাদ শরীরের ক্রমশ কেমন উবে যাচ্ছিল। দীর্ঘদিন পর ঠান্ডা জলের এই স্নান তাঁকে সুখী এবং তাজা যুবকের মতো ফের সেই পুরানো মন্দিরে উঠে যেতে প্রেরণা দিচ্ছে। তাঁর সেই স্বপ্নের কথা মনে হল, জলের জন্য অনুসন্ধান, স্বপ্নে কে যেন বলল—অনুসন্ধান কর, কোথাও না কোথাও নদীর ঢালুতে চোরা স্রোত রয়েছে, তুমি তাই খুঁজে বের কর।
সে আবার চিৎকার করে উঠল, মা সুবচনী, তোর জয় হোক! কিন্তু মা তোর মনে কী এই ছিল? তোর মাটিতে মা ফসল ফলে না, তোর মাটিতে মা আর পালা—পার্বণ নেই, সব খা খা করছে, সব জনহীন প্রাণীহীন মা, আমি এখন এই জলে কী করব মা। তোর জলে তুই ডুবে মর। তুই ডাইনি। সকলের হাড়—মাংস খেয়ে তুই সুবচনি এখন ধেই ধেই করে নাচছিস।
জনার্দন পাড়ে উঠে আলখাল্লা এবং পরনের কাপড়টা কাঁধে ফেলে একবার চারিদিকে তাকালেন। কবে সব মানুষজনদের নিয়ে তিনি জলের সন্ধানে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে চলে এসেছিলেন, এখন যেন আর তা মনে পড়ছে না। ভালোবাসার মাটি সকলে ছেড়ে চলে গেলে কী আর থাকল। জনার্দন, এই মাটি ছেড়ে সকলে কোথাও চলে যাবে ভাবতেই জলের জন্যে হতাশ হয়ে মরছিল। পাড়ে উঠে দেখল—তাঁর আবাস অনেক দূর। এত দূর তিনি হেঁটে যেতে পারবেন না, বিশেষ করে এই খরার রোদে। তিনি বালুর ওপর আর পা রাখতে পারছিলেন না, সূর্য যত ওপরে উঠে আসছে তত পায়ের নীচের উত্তাপ প্রখর মনে হচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি কোনও নিকটবর্তী গ্রামে উঠে যাবার জন্য প্রায় ছুটে চললেন। পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে এখন অন্তত সময়টা কাটিয়ে বেলা পড়ে এলে পর ছোট পাহাড়ে চলে যাবেন।
গ্রামের ভিতর ঢুকতেই জনার্দনের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখন আর এখানে মানুষের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয় কদমফুল গাছটা মরে গেছে। পুকুরের মাটি ফেটে গেছে। সব কেমন জ্বলেপুড়ে খা খা করছিল। কোথা থেকে পচা দুর্গন্ধ আসছিল। জনার্দন ছোট একটা কুঁড়েঘর দেখে ভিতরে ঢুকে গেলেন। বস্তুত জনার্দন ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন দরজার পাশে একটা ছেঁড়া গামছা ঝুলছে এবং বাতাসে গামছাটা নড়ছিল। জনার্দন ভয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লেন। মনে মনে বললেন, মা সুবচনি, এত ভয় কেন প্রাণের জন্য। কীসের ভয় মা। আর তো কেউ নেই মা। আমি পুত্র—কন্যাবিহীন। শুধু এক অহঙ্কার ছিল মা। অহঙ্কার আমার এই উপবীতের। তিনি তাঁর উপবীতে হাত রাখলেন। পুরুষানুক্রমিক এই উপবীত, উপবীতের অহঙ্কার, কে যেন হেঁকে গেল মাঠে, ঠাকুরমশাই, মেয়ের বিয়ে কোন মাসে দেব, ঠাকুরমশাই মাথা চুলকে কী দেখলেন, তারপর বইয়ের পাতায় কী পড়লেন, শেষে বলে দিলেন, সাতাশে শ্রাবণ। সন্তানের কী নাম হবে, তিনি নাম বলে দিতেন, পুত্র হবে না কন্যা হবে, তিনি বলে দিতেন, কবে জমিতে ধান চাষ হবে—তিনি বলে দিতেন, কালবৈশাখীর ঝড় থেকে রক্ষার জন্য ভৈরব পূজা দিতেন। বৃষ্টি না হলে হোম করতেন। সময়ে অসময়ে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ত। জলে ভেসে যেত মাটি। লাঙল কাঁধে তুলে সুবচনির মন্দিরে চাষি মানুষেরা যেত, তিনি লাঙলের ফলাতে সুবচনির তেল সিঁদুর মেখে দিতেন, গৃহস্থগণ চাষ করে আপন ঘরে সম্বৎসর সোনার ফসল তুলত।