পাখিটা হেগে—মুতে দিতে পারে এই ভয়ে প্রৌঢ় মানুষটি কিঞ্চিৎ সংশয় প্রকাশ করছিলেন। নোংরা সুবলকে সহ্য করতে পারছিলেন না। যেখানে সুবল বসছে ঠিক সেখানেই নোংরা লাগাচ্ছে। কিন্তু টুকুন পাখির নাম শুনেই বলল, সুবল, তুমি এখন পাখি ছেড়ে দিলে মাঠে উড়ে যাবে?
—না দিদিমণি। পাখি আমার পোষা। পাখির মা নেই বাবা নেই, আমার মতো পাখির কেউ নেই। আমাকে ফেলে পাখি আর কোথাও যাবে না দিদিমণি।
—দেখি, কেমন যায় না!
—কেন দিদিমণি, তুমি দ্যাখোনি পাখিটা আমাকে কেমন সব পোকামাকড় ধরে দিয়েছে?
—তা দিয়েছে তোমার পাখি।
—তবে এই দ্যাখো। বলে চোঙের মুখ খুলে দিল সুবল। সেই পাখি সোনার ঠোঁটে কিচমিচ করে উঠল। পেটের দিকে সাদা রঙ, পাখা কালো আর ঘন সবুজ রঙ পাখির পায়ে। পাখিটা প্রায় নেচে নেচে বেড়াল সারা কামরায়। পাখিটা দেয়ালে উড়ে গিয়ে বসল, ওপরের বাংকে বসে উঁকি দিয়ে যেন গাছের ডালে বসে উঁকি দিচ্ছে তেমনি পাখিটা নীচে টুকুনকে দেখল। টুকুন পাখিটাকে দেখল, মাঠের ভিতর খোলা আকাশের নীচে এই পাখি কত সুন্দর দেখাত—সুবল এক পাখিয়ালা কলকাতা যাচ্ছে। যেন বলছে, দেখো দেখো খেলা দেখো, পাখি আমার খেলা দেখাবে, নাচবে, গাইবে, হাওয়ায় উড়বে, ষাঁড় গোরুর মতো, ভালুক অথবা বাঁদর নাচের মতো, সুবল এক পাখিয়ালা কলকাতা নগরীতে অন্নসংস্থানের জন্য যাচ্ছে।
পাখিটা জানালায় বসল, পাখিটা টুকুনের শিয়রে বসে লেজ নাড়ল। আর পাখিটাকে টুকুন সামান্য আপেলের টুকরো দিল খেতে। শিয়রে বসে টুকুনের হাত থেকে পাখিটা ফলের নরম অংশ ঠুকরে ঠুকরে খেল।
তখন সুবল বসেছিল নীচে। ওর পোঁটলার ভিতর লুকনো বটফল, একমুঠো ফল মুখে ফেলে দিয়ে চিবুতে থাকল। প্রায় যখন ফেনা উঠে গেছে মুখে তখন দলাটা কোঁৎ করে গিলে ফেলল সুবল। ফের একমুঠো, ফের ফেনা ওঠা পিষ্টক সে খেয়ে সামান্য পাখিটার জন্য রেখে দিল হাতে।
সুবলের এই নোংরা স্বভাব দেখে টুকুনের মা ঘৃণায় মুখ কোঁচকাল, ঘৃণায় একবার চেকারবাবুকে ডেকে বলবে কিনা ভাবল, এখন তো খরা অঞ্চল নেই, এখন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের ভয় কি! সুতরাং এবার প্রায় টুকুনের মা ধমক দিয়ে বলল, সামনের স্টেশনে তুমি বাপু নেমে যাবে।
সুবল বলল, তাই যাব মা। স্টেশনের কী নাম?
—স্টেশনের নাম ব্যান্ডেল।
—যাব মা। সেখান থেকে কলকাতা কতদূর মা?
অত কথা শুনতে ভালো লাগল না। কোথাকার কোনও এক মানুষ, উটকো মানুষ মা মা বলে একেবারে কামরাটাকে কদাকার করে তুলছে। সে বলল, মা, আমি তো আপনাদের কোনও অনিষ্ট করছি না।
টুকুন শুনছিল সব। সে দেখল সুবল ভয়ে কেমন চুপ মেরে গেছে। সুবল ওর সব সম্বল নিয়ে এসেছে বলে পোঁটলা খুলে দেখল, ছোট ছোট পোঁটলার কোনোটায় চন্দনের বীচি, কোনোটাতে পুঁতির মালা।
তার মা একবার মেলা থেকে একটা পুঁতির মালা কিনে দিয়েছিল আর রঙবেরঙের সব পাথর, সে সেইসব পাথর পাহাড়ের নুড়িপাথর থেকে সংগ্রহ করেছে। সে কিছুই ফেলে না। যা ভালো লাগে, যা কিছু ভালো লাগে—সবই সঞ্চয়ের সামিল এই ভেবে সব সে সঞ্চয়ের ঝুড়িতে জমা রেখে দিত। চন্দনের বীচি, কুঁচফল এবং ভিন্ন ভিন্ন পাথরের উজ্জ্বল রঙ টুকুনকে পুলকিত করছিল। টুকুন মাকে ভয় পায়, মা সুবলকে নেমে যেতে বলেছেন, টুকুনের কষ্ট হচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল টুকুনের, কারণ সুবলের কেউ নেই—কত আর বয়েস সুবলের, সে সময় পেলে পাখির খেলা দেখায়। অথবা কোনও কোনও সময় ঋষিপুত্রের মতো মনে হয় যেন সুবলকে, সবচেয়ে বড় আশ্চর্য, সুবলের জন্য টুকুন দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পেরেছিল। যেন এক দৈবশক্তি ভর করেছিল টুকুনের পায়ে। অথবা সুবল মন্ত্র—টন্ত্র পড়ে টুকুনকে হাঁটতে সাহায্য করেছে। এই সুবল চলে গেলে সে সত্যই পঙ্গু হয়ে যাবে। আর কোনওদিন সে হেঁটে গিয়ে জানালায় দাঁড়াতে পারবে না, কোনওদিন সে খোলা আকাশের নীচে আর দৌড়তে পারবে না।
তিন
তখন খোলা আকাশের নীচে একটা গাছ, কী গাছ হবে, চড়ুইগাছ অথবা অর্জুন গাছ হতে পারে। গাছে পাতা নেই, রোদ এসে মুখের ওপর পড়ছে, প্রথমে মনে হচ্ছিল কেউ অন্ধকার রাতে ওর সামনে আলো বহন করে এনেছে, সে সচকিত হয়ে চোখ খুলল, মাথার ওপর প্রখর রোদ, সামনে খোলা মাঠ, শুধু ধুধু করছে মাঠের রোদ। ঝিল্লির আঁকাবাঁকা রেখা দিগন্তে পাখির মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মরীচিকার মতো মনে হচ্ছিল। বৃদ্ধ পুরোহিত প্রথমে শরীরের আলখাল্লা খুলে ফেললেন। মরীচিকার মতো এই জলের চিহ্ন তিনি দেখতে পাচ্ছেন, মাঠ পার হয়ে হয়তো আকাশের নীচে কোথাও কোনও মেঘের টুকরো উঠে আসছে, তিনি জলের সন্ধানে এই মরুভূমির মতো প্রান্তরে ছুটতে থাকলেন। তাঁর কোনও জ্ঞান ছিল না। তিনি প্রায় পাগলের মতো ছুটে চলেছেন, যদি কোথাও কোনও জলের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।
আর তিনি ঠিক নীচে এসে যেখানে গতকাল মানুষেরা নদীর ঢালুতে জল অনুসন্ধান করে গেছে, সেখানে থমকে দাঁড়ালেন। দক্ষিণ অঞ্চল থেকে একটি ছোট্ট পাহাড়ের শিরা বের হয়ে এসেছে। দু’দিকে পাহাড়ের উপত্যকা গিরিখাতের মতো সৃষ্টি করেছে। তারই নীচে ছোট পাতকোর মতো গর্ত। বালুর পাহাড় চারধারে। একের পর এক এই সব গর্ত গতকাল তাঁর দলের মানুষেরা করে গেছে। কোনও গর্তেই জল নেই তিনি তা জানতেন। শুধু দূরে দেখলেন তিনটি ছোট ছোট প্রাণী একটা গর্তের চারধারে কেবল ঘুরছে। এই খরা অঞ্চলে, জলের অভাবের জন্য যেখানে কোনও পাখপাখালি পর্যন্ত নেই, যেখানে কোনও কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না, সেখানে এমন তিনটি প্রাণী দেখে বিস্মিত হলেন।