সুবল বাংকের নীচে চুপ মেরে শুয়ে আছে। এখন বের হলে যে কোনও আর ভয় নেই সে তা বুঝতে পারছে না। ওর ধারণা পুলিশ এখনও এই ট্রেনে দলবল নিয়ে ঘুরছে। সে এতটুকু নড়ছিল না। সে পাখিটাকে পর্যন্ত হাতের ইশারাতে দুষ্টুমি করতে বারণ করে দিল। কারণ ভোর হয়ে গেছে বোধহয় আর খরা অঞ্চলের ওপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে না। সে ট্রেনে শুয়ে শস্যের গন্ধ পেল। এই শস্যের গন্ধ পেয়ে পাখিটা কেমন শক্তি পাচ্ছে ভিতরে। ওর ফুর ফুর করে উড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে এত উত্তেজিত যে বাংকের নীচেই দু’বার ফুর ফুর করে উড়ে মাথায়—মুখে এসে সুবলের পাশে বসে পড়ল।
সুবল এতটুকু নড়ছিল না। সে পাখিটার দুষ্টুমি ধরতে পেরে বাঁশের অন্য একটা চোঙ টেনে আনল সন্তর্পণে। তারপর পাখিটাকে চোঙের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। এবং মুখ বন্ধ করে বলল, বড় বজ্জাত পাজি তুই। বড় শহরে না গেলে তোমাকে আর ছেড়ে দিচ্ছি না।
টুকুন নিজের পায়ের ওপর চোখ রেখেছিল বিস্ময়ে! মা—বাবা উঠে গেছেন। টুকুন ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, মা, আমি উঠে দরজা পর্যন্ত গেছি, দরজা খুলে দিয়েছি।
মা এত বিস্মিত যে কথা বলতে পারছিলেন না। বোধহয় টুকুন স্বপ্নের কথা বলছে।
—বাবা, পুলিশ এসেছিল।
বাবা টুকুনকে দেখতে থাকলেন। কথা বলতে পারছিলেন না।
—বাবা, সত্যি আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি। ওরা সুবলকে ধরতে এসেছিল। আমি বলেছি এখানে কেউ নেই।
বাবা এবার দরজার দিকে চোখ তুলে দেখলেন, দরজা তেমনি লক করা আছে। তিনি ভাবলেন টুকুন হয়তো কোনও স্বপ্ন দেখেছে। টুকুন স্বপ্ন দেখেছে কোনও মাঠ অথবা ওর প্রিয় লেবুতলায় সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ওর শরীরের সমস্ত শিরা—উপশিরা শুকিয়ে আসছে। পায়ের কোথাও আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। কেমন ক্রমশ টুকুন স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কোনও জায়গা নেই, বড় ডাক্তার নেই যেখানে তিনি টুকুনকে নিয়ে না গেছেন। হতাশা এখন সম্বল। মেয়েটা ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাবে তারপর সতেজ মুখে আর কোনও বিষণ্ণ ছবি ঝুলে থাকবে না। টুকুন মরে যাবে। বাবা তার এই স্বপ্নটুকু ভেঙে দিতে চাইলেন না।—বাঃ, বেশতো টুকুন, তুমি হেঁটে গিয়েছ, বাঃ, বেশতো। আমি তো বলেছি তুমি আজ হোক কাল হোক হাঁটতে পারবে। তুমি হেঁটে হেঁটে কোথাও না কোথাও চলে যেতে পারবে।
—বাবা, আমি হেঁটে হেঁটে এই বাংকে এসে শুয়ে পড়েছি। আমি সুবলকে পর্দার আড়ালে রেখে দিয়েছি, সব আমি বাবা নিজের হাতে করেছি। আমি পায়ে হেঁটে করেছি। বলে টুকুন ফের উঠে বাবাকে দেখাতে চাইল, আমি হাঁটতে পারি, মাকে দেখাতে চাইল, এই দেখ আমার পায়ে কেমন শক্তি, কিন্তু হায়, টুকুন শত চেষ্টা করেও পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারল না, অতীব আশার উত্তেজনা ওকে বড় অসহায় করে তুলছে। তবে কী সব ভোজবাজির মতো হয়ে গেল! টুকুন কত চেষ্টা করল। কতভাবে চেষ্টা করল। প্রাণে সকল আবেগ ঢেলে চেষ্টা করল, কিন্তু হায়, টুকুন কিছুতেই আর নিজের চেষ্টায় উঠে বসতে পারল না। টুকুন ভয়ঙ্কর হতাশায় ফের কেঁদে ফেলল, মা, আমার কিছু ভালো লাগে না, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, কোথাও আমি চলে যাব।
হায়, মেয়েটার দিকে এখন আর তাকানো যাচ্ছে না। সতেজ মুখে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। সাদা জামা, চোখের জলে ভিজে গেল। সারাজীবন ধরে কান্না। কী এক দুরারোগ্য ব্যাধি, কী এক অসীম হতাশা এই পরিবারকে ক্রমশ গ্রাস করছে। টুকুন ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। হাত—পা অচল হয়ে যাচ্ছে। ভিতরের শিরা—উপশিরা শুকিয়ে যাচ্ছে, রোগের কোনও কারণ নির্ণয় করা যাচ্ছে না।
ট্রেন চলছিল। পাখি উড়ছিল আকাশে। লাইনের তারে কিছু শালিখ পাখি দেখতে পেল ওরা। কত গ্রাম—মাঠ ফেলে ট্রেন ছুটছে। জানালায় ছোট ছোট কুঁড়েঘর, বড় দিঘি, কালো জল, সবুজ মাঠ ভেসে উঠছিল। যত ট্রেন বড় শহরের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে তত লোকালয়, ইট—কাঠের বাড়ি, কারখানার চিমনি এবং লোহার পুল। সুবল বাংকের নীচে থেকে উঠে এলে দেখতে পেত সব। বোধহয় সুবল ফের ঘুমিয়ে পড়েছে বাংকের নীচে। সুবলকে ঘুমুতে দেখে পাখিটা চোখের ভিতর কিচমিচ করছিল। ছটফট করছিল ভিতরে। ফুর ফুর করে ওড়বার ইচ্ছা পাখির, পাখি কেন আর এখন চোঙের ভিতর থাকবে। দুষ্টু পাখি সুবলের কানের কাছে চোঙের ভেতর থেকে বের হবার জন্য কিচমিচ করে প্রায় কোলাহল জুড়ে দিল।
বোধহয় সুবল পুলিশের ভয়ে ঘাপটি মেরে আছে। নড়ছে না। পাখিটা চোঙের ভেতর থেকে ভাবছে সুবল ঘুমোচ্ছে। টুকুন ভাবছে সুবল ঘুমুচ্ছে। মা—বাবা এ—ঘরে সুবল আছে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কারণ এঁরা সুবলকে দেখতে পাচ্ছেন না। চাদরটা মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সুবলের হাত—পা—মুখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। সবটাই স্বপ্ন টুকুনের। সুবল, পাখিয়ালা সুবল চলে গেছে।
আর ঠিক তক্ষুনি সুবল চাদর ফাঁক করে কচ্ছপের মতো মুখ বার করে বলল, মা পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে নেই তো। মা, আমরা আর কতক্ষণ ট্রেনে? পুলিশ আমাকে ধরবে না তো! টুকুন শুয়ে শুয়ে বলল, তুমি কতদূর যাবে সুবল?
—আমি কলকাতা যাব দিদিমণি।
—সেখানে কে আছে সুবল?
—আপন বলতে কেউ নেই। বলে সুবল হামাগুড়ি দিয়ে চাদরটা সরিয়ে বের হয়ে এল। নোংরা জামাকাপড় বলে সে এক কোণায় মেঝের ওপর জবুথবু হয়ে বসল। সে দু’হাত জোড় করে বলল, মা, পাখিটা আমার বের হতে চাইছে। বের করব? পাখিটা একটু উড়তে চাইছে।